স্বচ্ছতার অভাব ও অভ্যন্তরীণ চাঁদাবাজি: পার্কন চৌধুরীর ‘অদৃশ্য নেটওয়ার্ক’ (প্রথম পর্ব)

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির অভিযোগে পরিপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নাম পার্কন চৌধুরী, যিনি বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এবং একইসঙ্গে রংপুর বিভাগের দায়িত্বও পালন করছেন।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে পার্কন চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জরুরি লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ম অমান্য করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, আবেদনকারীদের প্রক্রিয়া জটিল করে দীর্ঘদিন আটকে রাখা এবং বিদেশগামী সেবাগ্রহীতাদের জন্য অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স বিতরণের মতো কার্যক্রম।

ঘটনাগুলো শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতির সীমা অতিক্রম করে, বরং পুরো সংস্থার স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার প্রশ্ন উত্থাপন করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যথাযথ প্রশাসনিক তদারকি ও স্বাধীন তদন্ত ছাড়া এই ধরনের অনিয়ম চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব নয়।

অনুসন্ধান জানা গেছে, বিদেশগামী সেবাগ্রহীতাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে লাইসেন্স প্রদানের নামে সরাসরি বিআরটিএ রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালকের দপ্তরে গোপন সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ উঠে।

অনুসন্ধান বলছে, বিদেশগমন সংক্রান্ত লাইসেন্স দ্রুত পেতে চাইলে আবেদনকারীদের সরাসরি পরিচালকের দপ্তরে আবেদন করার বিধান থাকলেও, প্রকৃতপক্ষে আবেদন প্রক্রিয়া জটিল এবং প্রভাবশালী পার্কন চৌধুরী অর্থের বিনিময়ে সম্পন্ন করে থাকে। সূত্র জানায়, হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলির মাধ্যমে এই অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স বিতরণ করা হচ্ছে।

এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “যারা জরুরি ভিত্তিতে লাইসেন্স নিতে চায়, তাদেরকে নির্ধারিত নিয়মের বাইরে অর্থ প্রদান করতে হয়। না দিলে আবেদন দীর্ঘদিন আটকে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় আবেদনকারীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়, যাতে তারা বাধ্য হয় সিন্ডিকেটের নিয়ম মেনে চলতে।”

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এই সিন্ডিকেট কেবল অর্থ আদায়ে সীমাবদ্ধ নয়; যারা ‘নির্ধারিত পথে’ অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের আবেদন কার্যত আটকে রাখা হয়। বিষয়টি প্রশাসনিক তদারকির আওতায় আনা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিচালকের দপ্তরে একটি সূত্র বলেন, “যারা দ্রুত লাইসেন্স পেতে চায়, তাদেরকে নির্ধারিত টাকার অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। তা না দিলে আবেদন দীর্ঘদিন আটকে থাকে।”

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এই সিন্ডিকেট শুধু অতিরিক্ত অর্থ আদায়েই সীমাবদ্ধ নয়; যারা ‘প্রদত্ত নিয়মের বাইরে’ থাকেন, তাদের আবেদন প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

এ ঘটনায় বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও সরাসরি দায় রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার দাবি উঠছে।,

উপপরিচালক পদের এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে উচ্চ পদে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ায় বিআরটিএর অভ্যন্তরে ভেতরে সমানো, অনিয়মের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠে। এতে সাধারণ কর্মকর্তারা প্রতিদিন হয়রানি ও চাপে পড়ছেন, এবং স্বচ্ছতা নেই এমন একটি পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিআরটিএর সূত্র বলছে, দায়িত্ব পালনের নামে যে অনিয়ম ও ঘুষ–দুর্নীতির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তিনি সৃষ্টি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, তা দিন দিন নতুন মাত্রা পাচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, এমনকি ঢাকায় তাঁর পূর্ববর্তী দায়িত্বকালেও সীমাবদ্ধ নয়—রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলেও নিয়মিত ‘টাকার কারবার’ চলছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রো-৪ এ দায়িত্বে থাকাকালীনও ছিল গুরুতর অনিয়ম পার্কন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ইতিহাস নতুন নয়। ঢাকা মেট্রো-৪ এর উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালীন বিভিন্ন ফাইল আটকে অর্থ আদায়, প্রশিক্ষণ খাতের বরাদ্দে হেরফের,লাইসেন্স সংক্রান্ত আবেদন নিষ্পত্তিতে ঘুষ, টুলপ্লাজা ও ভ্যারিফিকেশন ফাইল নিয়ে অস্বচ্ছ লেনদেন এমন অসংখ্য অভিযোগ ওঠে পার্কন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তবে প্রশাসনিক অদৃশ্য সুরক্ষা বা প্রভাবশালী মহলের ছায়া তাঁকে বাঁচিয়ে দেয় প্রতিবারই। ফলে, শাস্তির বদলে নতুন দায়িত্ব—যা এখন রাজশাহী ও রংপুরে এসে আরও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

টুর পরিদর্শনে ‘অঘোষিত চাঁদা’—রংপুর সার্কেল থেকে মাসিক অর্থ নেওয়ার অভিযোগ বিআরটিএর অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের দাবি, পার্কন চৌধুরী রংপুর সার্কেল থেকে নিয়মিত মাসিক অর্থ নেন।

রংপুর সার্কেলের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, টুর পরিদর্শন মানেই কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দেয় আতঙ্ক—কারণ পরিদর্শনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নাকি ঘুষ আদায়।

একজন কর্মকর্তা বলেন,“পরিদর্শন বলতে যা বোঝায়—নথি দেখা, অনিয়ম খুঁজে বের করা—এসব কিছুই হয় না। বরং আগে থেকেই কার কত দিতে হবে তা ঠিক করে দেওয়া হয়।”

তিনি আরও বলেন,“পরিদর্শনের সময় সার্কেল অফিসে অকারণে বিভিন্ন ফাইল ধরে সবাইকে চাপে রাখা হয়—উদ্দেশ্য একটাই, টাকা।” তবে ভয়, হয়রানি ও বদলির আশঙ্কায় কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না।

সূত্র বলছে, বিআরটিএর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে চলছে বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট।

সেখানে হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলিকে নিয়ে পার্কন চৌধুরী একটি বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভুয়া খাতে ব্যয় সৃষ্টি যে কাজ বাস্তবে হয়নি, সে কাজের বিল দেখানো ওভাররেট বিল ভাউচার তৈরি একই প্রকল্পের বাজেট দুইবার দেখানো, অফিস মেরামত, ভাড়া, স্টেশনারি—সবকিছুতেই মিথ্যা ব্যয় এসব দেখিয়ে সরকারি অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পার্কন চৌধুরী যোগদানের পর ভাউচার আছে যেখানে বাস্তবে এক টাকাও খরচ হয়নি, অথচ দেখানো হয়েছে সরকারি বিপুল ব্যয়। কারা চেক পাশ করায়—এসব সবার জানা।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন, “হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলি এবং পার্কন চৌধুরী ছাড়া ভাউচারের কাগজে অন্য কেউ হাত দিতে পারে না।”

ঢাকা পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকাকালীন পার্কন চৌধুরীর প্রশিক্ষণ বাজেট আত্মসাৎ ছিল আলোচিত ঘটনা।

সূত্র জানায়, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো খরচের মিথ্যা বিবরণ ভ্রমণ খরচের ডুপ্লিকেট ভাউচার পুরনো রসিদ ব্যবহার এবং ‘টোকেন ট্রেনিং’ দেখিয়ে টাকা উত্তোলন এমন অসংখ্য অভিযোগ অডিটে ধরা পড়ে।

কিন্তু পরে রহস্যজনকভাবে সেই অডিট রিপোর্ট চুপ হয়ে যায়, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

একাধিক কর্মকর্তা বলছেন,“অডিট রিপোর্ট গায়েব হয় না, গায়েব করানো হয়। যেভাবে ঢাকায় অডিট ‘ম্যানেজ’ করা হয়েছিল, সেই অভ্যাস তিনি এখনো অব্যাহত রেখেছেন।”

কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুললে বদলি বা হয়রানির ভয় বিআরটিএর ভেতরে এখন আতঙ্কের পরিবেশ। অনেকে অভিযোগ করেছেন—যে কর্মকর্তা অনিয়ম দেখিয়ে প্রতিবাদ করেন, তাকে বদলি বা হয়রানির শিকার হতে হয়।

একজন সার্কেল কর্মকর্তা বলেন,“পদ বদলির ক্ষমতা তাঁর হাতে, তাই কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। অভিযোগ করলেই বদলি—এটাই বাস্তবতা।”

কেউ কেউ এটিকে দুর্নীতির নিরাপদ এলাকায় পরিণত হওয়ার বড় কারণ হিসেবে দেখছেন। তদন্ত হয় না, ফাইল চাপা পড়ে—কারা তাঁকে রক্ষা করছে?

বিআরটিএর ভেতর বড় প্রশ্ন? এত অভিযোগ অডিটে ধরা পড়ার পরও কেন তদন্ত হয় না? কেন বারবার ফাইল থেমে যায়?

রংপুর সার্কেলের এক কর্মকর্তা বলেন,“যারা দুর্নীতি করেন, তারা একা করেন না। পুরো ‘চেন’ জড়িত থাকে। সেখানেই তারা নিরাপত্তা খুঁজে পান।”

স্বচ্ছ তদন্ত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের দাবিরা ষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সুশাসন রক্ষায় বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, এই অভিযোগগুলো শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থার বিরুদ্ধে।

তারা দাবি করেন, সত্যিকারের স্বচ্ছ তদন্ত অভিযোগকারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা রাজশাহী–রংপুর সার্কেল থেকে অর্থ আদায়ের চাঁদাবাজি বন্ধ বিল–ভাউচার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া ঢাকার পুরনো অডিট রিপোর্ট পুনরায় মূল্যায়ন এগুলো না হলে বিআরটিএর দুর্নীতি আরও ভয়াবহভাবে বিস্তার পাবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর রাজশাহী বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) পার্কন চৌধুরী বলেন, যদি আপনাদের কাছে ডকুমেন্টস থাকে সংবাদ আপনারা প্রকাশ করুন সমস্যা নেই।

জানতে চাইলে বিআরটিএর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ আলি বলেন, অফিসে আসুন সাক্ষাৎ করে কথা বলবো মুঠোফোনে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

Next Post

রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে অবরোধ

রবি নভে. ২৩ , ২০২৫
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। শনিবার বিকেলে গোদাগাড়ীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে এ কর্মসূচি পালিত হয়। বিকেলে রাজশাহী-১ আসনের আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সুলতানুল ইসলাম তারেকের অনুসারীরা গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ি বাজার থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক হয়ে সিঅ্যান্ডবি মোড়ে যায়। […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links