ava desk : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। এদের মধ্যে ছয়জন কারাগারে বাকি দু’জন পলাতক। সোমবার বিকালে গুলশান থানার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ওসি হুমায়ুন কবীর অভিযোগপত্র জমা দেন। ঢাকা মহানগর হাকিম নুর নাহার ইয়াসমিনের আদালতে অভিযোগপত্র উপস্থাপনের পর এটি গৃহীত হয়েছে বলে প্রসিকিউশন সূত্র জানিয়েছে। ঘটনায় জড়িত ‘চিহ্নিত’ বাকি ১৩ জন এরই মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। ২৬ জুলাই মামলার প্রতিবেদন দাখিলের পূর্বনির্ধারিত ধার্য তারিখে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে যথাযথ আদেশ পাওয়া যাবে।
সোমবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গুলশান হামলায় জড়িতদের মধ্যে নিহত ১৩ জনের পাঁচজন নিহত হয় হলি আর্টিজান হামলায় অভিযানের সময়ই। এরা হচ্ছে- রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। বাকি আটজন বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত হয়। এরা হচ্ছে- তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। কারাগারে থাকা ছয় আসামি হল- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এবং হাদিসুর রহমান সাগর। পলাতক দুই আসামি হল- শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
৬ মাস আগে পরিকল্পনা : হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা হয় ৫-৬ মাস আগেই। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করা ছাড়াও আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল তাদের টার্গেট। বিশ্বের বড় বড় জঙ্গি সংগঠনের কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। তাদের ধারণা ছিল, হামলার মধ্য দিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলে মিলবে অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা। মনিরুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সংখ্যায় বিদেশিকে হত্যা করা যাবে তত বেশি দেশি-বিদেশির দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। তিনি বলেন, হামলার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে সরকারকে কোণঠাসা করা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে এ দেশে না আসে। যেসব বিদেশি সংস্থা দেশে উন্নয়নমূলক কাজ করছে তারা যেন চলে যায়, আর যেন ফিরে না আসে। এছাড়া বেকায়দায় পড়ে সরকার যেন সাধারণ মানুষকে নির্যাতন ও হয়রানি করে অতিষ্ঠ করে তোলে। এ ফাঁকে জঙ্গিরা থেকে যাবে অধরা। আর এ সুযোগে সাধারণ লোকজনকে জঙ্গিবাদে যুক্ত করারও টার্গেট ছিল হামলার পরিকল্পনাকারীদের।
হলি আর্টিজান বেছে নেয়ার কারণ : হামলার আগে হলি আর্টিজান ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি স্থান রেকি করে জঙ্গিরা। এ বেকারিটি বেছে নেয়ার কারণ উল্লেখ করেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হলি আর্টিজানের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ফলে সহজে সেখানে প্রবেশ করা যাবে, পাওয়া যাবে বেশিসংখ্যক বিদেশি। তিনি বলেন, এ হামলায় অংশ গ্রহণকারী পাঁচ জঙ্গির দু’জন গ্রামে বেড়ে ওঠা। বাকি তিনজন ছিল শহুরে। ঢাকায় হামলার টার্গেট নিয়েই গাইবান্ধার চরে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। হামলাকারীদের মধ্যে শফিকুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলাম ছিল পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ঢাকায় হামলার জন্য শহরে ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে দরকার। তাই শহুরে ব্যাকগ্রাউন্ডের চারজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে হামলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। তাদের মধ্যে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলামকে হলি আর্টিজানে হামলার জন্য পাঠানো হয়। চতুর্থ জঙ্গিকে পাঠানো হয় শোলাকিয়ায়। পুলিশি অভিযানে সে সেখানে নিহত হয়।
যে কারণে তদন্তে ২ বছর : এক প্রশ্নের উত্তরে মনিরুল বলেন, এ ঘটনায় সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছিল তারা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। জীবিত কাউকে ধরা যায়নি। ফলে আলামত পরীক্ষা ও প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করতে সময় লেগে যায়। বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকালেও এ ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। তাদের জীবিত ধরতে পারলেও বেশ কিছু তথ্য পেতাম, তদন্তও দ্রুত শেষ হতো। এছাড়া তদন্ত যাতে নির্ভুল হয়, এ কারণে আমাদের কিছু সময় লেগেছে। মনিরুল বলেন, ‘বিদেশি ১৭ জন, তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক এবং দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা এ হামলায় নিহত হয়েছেন। তাদের আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এটি আমাদের ব্যর্থতা। তবে আমরা চেয়েছি অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে, যাতে তাদের স্বজনরা শান্তি পান। মনিরুল বলেন, ওই সময় ভেতরে থাকা ১৭ জন জীবিত ব্যক্তির জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছি, ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠিয়েছি। কিছু আলামত বিদেশে পরীক্ষা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রও স্বজনদের ফেরত দিয়েছি।
হাসনাত করিম ও শাওন বাদ : এজাহারে নাম থাকলেও অভিযোগপত্রে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের নাম নেই। নাম নেই শাওনেরও। জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, মামলার এজাহারের কলামে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী হাসনাত করিমের নাম ছিল না। বডিতে নাম ছিল।
যাদের জীবিত উদ্ধার করেছি, এমন ১৭ জনের জবানবন্দি আদালতে দেয়া হয়েছে, পাশাপাশি যে আসামি জীবিত উদ্ধার হয়েছে, তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং আলামত যাচাই-বাছাই করে যাদের সম্পৃক্ততার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের নাম অভিযোগপত্রে দেয়া হয়েছে। হাসনাত করিম ছাড়াও চার্জশিট থেকে সাইফুল চৌকিদারসহ তিনজনকে বাদ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নব্য জেএমবির একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনায় এ হামলা হয়। তাদের এ পরিকল্পনার কোথাও হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। হাসনাত করিমের দেয়া ব্যাখ্যার চেয়েও অন্য যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাদের জবানবন্দির ওপর আমরা নির্ভর করেছি এবং অভিযোগপত্রে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। হামলার পর হলি আর্টিজানের প্রকাশিত ছবি নিয়ে হাসনাত করিমের ব্যাখ্যা কী? জবাবে তিনি বলেন, ছবিগুলো আমরা বিশ্লেষণ করেছি। আদালতে তার ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
হামলায় আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা কতটুকু? : এক প্রশ্নের উত্তরে মনিরুল ইসলাম বলেন- এ ঘটনায় তামীম, সারওয়ার, মারজানের মতো নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের কাউকেই জীবিত গ্রেফতার করতে পারিনি, তারা অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের জীবিত ধরতে পারলে নিশ্চিত হতে পারতাম। কিন্তু অন্য যাদের জীবিত গ্রেফতার করেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং আমাদের টেকনোলজিক্যাল এভিডেন্সে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কোনো তথ্যপ্রমাণ পাইনি। তবে আমরা মনে করি, তদন্তে আমাদের যে একটা ল্যাকিংস ছিল সেটি হচ্ছে- কেন্দ্রীয় জঙ্গি নেতাদের জীবিত ধরতে না পারা। এ ঘটনায় সাইফুল্লাহ ওযাকির কিংবা বিদেশে অবস্থানরত অন্য কারও নাম কিংবা আন্তর্জাতিক সংগঠনের নাম পাইনি। নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলেও থাকতে পারত। তবে তামীম যেহেতু নেতা, আন্তর্জাতিক কারও সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারই করার কথা ছিল। এছাড়া তার ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো অভিযানের আগেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তাই বিদেশি কোনো সংগঠন, আইএস কিংবা আল কায়দা, হিযবুত তাহরির কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য আমরা পাইনি।
এর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে কূটনীতিকপাড়া গুলিশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। তাদের ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। রাতভর উৎকণ্ঠার পর ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর অপারেশন ‘থান্ডারবোল্ট’র মধ্য দিয়ে সংকটের অবসান ঘটে।
jugantor