ava desk : তিন দিনের সম্মেলন শেষে দুই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন জেলা প্রশাসকরা। একটি রিটার্নিং অফিসার হিসেবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা।
অপরটি প্রায় ২০ লাখ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়া। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘মুক্ত আলোচনায়’ ডিসিদের এ নির্দেশনা দেয়া হয়। বিভিন্ন অধিবেশনে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তার মধ্যেও এগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারি সেবা পেতে মানুষের হয়রানি বন্ধ করাসহ ডিসিদের প্রতি ২৩ দফা নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী-উপদেষ্টারা জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন নিজ নিজ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্ম অধিবেশনে। একাধিক ডিসি বলেন, প্রতিটি জেলার নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন সংশ্লিষ্ট ডিসি।
এ কারণে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছেন সবাই। যে কারণে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রী ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। মূলত এ কারণেই কাজটিকে জেলা প্রশাসকরা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন। সম্মেলনের শেষদিন বৃহস্পতিবার একাধিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব অধিবেশনে মন্ত্রী প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
এদিন নিজ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত অধিবেশন শেষে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বর্তমানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ৫৭ ধারায় মামলা হয় না। মন্ত্রী বলেন, ‘৫৭ ধারা প্রকৃতপক্ষে ডেড। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বুধবার স্থায়ী কমিটিতে প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে।
এটি পাস হওয়ার পর ৫৭ ধারা নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে না। এছাড়া সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠপ্রশাসনের ৩৪৭টি বাধাসহ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশকিছু প্রস্তাব সম্মেলনে উপস্থাপন করা হলেও তাতে অতীতের মতোই মিলেছে শুধুই আশ্বাস। সম্মেলন শেষে একাধিক ডিসির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘শাপলা’ হলে তিন দিনের এই ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন ৮ বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জেলার ডিসি।
রুদ্ধদ্বার এ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মাঠপ্রশাসনের নানা সমস্যা ও বাধা তুলে ধরেন ডিসিরা। এ সময় মনোযোগ সহকারে তাদের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা শোনেন প্রধানমন্ত্রী। কিভাবে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনার পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনে মাঠপ্রশাসনের শীর্ষকর্তা হিসেবে তাদের করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দেন শেখ হাসিনা।
ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের চাপের ব্যাপারে কোনো কোনো ডিসি অভিযোগ তোলেন। কিন্তু ডিসিদের এসব চাপকে হজম করে নির্ভয়ে সরকারি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূলে ডিসিদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, বিনা দ্বিধায় আপনারা এই টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি, সন্ত্রাস, মাদক- এগুলো নির্মূল করবেন। এখানে কে কোন দল করে, কে কী করে- ওগুলো দেখার কোনো দরকার নেই।
দেশের প্রতিটি কওমি মাদ্রাসার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসাগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। সাবধানে এগোতে হবে। তাদের এ পর্যায়ে আনতে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক দিনের এ অর্জন যেন নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে।
তাদের মূলধারার সঙ্গে মিলাতে হবে। দাওরায়ে হাদিস মাস্টার্সের সমমান দেয়ার পর তাদের মাদ্রাসার ছাত্ররাই সরকারি চাকরি পাবে। কওমি মাদ্রাসাগুলোকে আস্থায় নিতে হবে। কওমি মাদ্রাসাসহ দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ : জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য ডিসিদের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। বৃহস্পতিবার সম্মেলনের শেষদিনের শেষ কার্য-অধিবেশনে তিনি এ নির্দেশ দেন। অধিবেশন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ডিসিদের বলেছি, নির্বাচন আসছে। নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পর শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনী প্রস্তুত আছে। তাদের সক্ষমতাও যথেষ্ট বৃদ্ধি হয়েছে।
ইলেকশন কন্ডাক্টে তাদের প্রয়োজনীয় জনবল, লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে। যেগুলো বাকি আছে, তা দেয়া হবে। তিনি বলেন, তাদের (ডিসি) আহ্বান করেছি একটা সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে। এজন্য দায়িত্বটা যেন তারা সঠিক সময়ে সঠিকভাবে পালন করেন, এ বিষয়ে বলা হয়েছে।
বন্ধ হবে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ : এদিকে ডিসি সম্মেলনের শেষদিনে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হয় স্বীকার করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে ওই ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে।
নিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কর্মঅধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আইসিটি আইনটির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এর ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ। কাজেই অপপ্রয়োগটা যাতে না হয়, সেই জায়গাটা নিশ্চিত করাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য।’ অপপ্রয়োগের জায়গাটাকে আমরা বন্ধ করার চেষ্টা করছি।’ বর্তমানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ৫৭ ধারায় মামলা হয় না দাবি করে মন্ত্রী বলেন, ‘৫৭ ধারা বস্তুতপক্ষে ডেড। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বুধবার স্থায়ী কমিটিতে প্রায় চূড়ান্ত করেছি। সেটি পাস হওয়ার পর ৫৭ ধারা নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকবে না, সুতরাং এটা নিয়ে টেনশনেরও কোনো কারণ নেই।
৫৭ ধারায় হওয়া মামলাগুলো স্বাভাবিক গতিতে আইনানুগভাবে নিষ্পত্তি হবে। তিনি বলেন, যে মামলা যেভাবে যে আইনের আওতায় আছে, ওটা ওভাবেই নিষ্পত্তি হতে হবে। ৫৭ ধারার কোনো ধারণা আমরা নতুন আইনে রাখিনি।
মামলা নিষ্পত্তিতে প্রতি জেলায় সমন্বয় কমিটি : অনিষ্পন্ন ৩৪ লাখ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য জেলা জজের নেতৃত্বে ‘জেলা মামলা সমন্বয় কমিটি গঠন’ করা হচ্ছে। এ কমিটি যেন সঠিকভাবে কাজ করতে পারে, সে বিষয়ে ডিসিদের সহায়তা চেয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। নিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কর্মঅধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের আরও বলেন, আমরা মামলা জটে জর্জরিত, যা আমরা ইনহেরেন্ট করেছি। প্রায় ৩৪ লাখ মামলা অমীমাংসিত রয়েছে।
এ অবস্থায় আমরা নতুনভাবে জেলা জজকে প্রধান করে ‘ডিস্ট্রিক কেইস কোর্ডিনেশন কমিটি’ গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ কমিটি সাক্ষী বা ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট দ্রুত আসতে সহায়তা করবে।
পশুর হাট ‘অস্থির’ না করার নির্দেশ : কোরবানির পশুর হাটে প্রভাব খাটিয়ে কেউ যাতে ‘অস্থিরতা’ সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। নিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কর্মঅধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের আরও বলেন, কোরবানির হাটে পশুর স্বাস্থ্যের বিষয়ে ডিসিদের নজর দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাটে যে পশু আসবে, সেগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। নিরাপদ ও সুন্দর স্বাস্থ্যের পশুগুলো যাতে কোরবানির জন্য যেতে পারে। ম্যানেজমেন্ট ঠিক রাখতে পারলেই কোরবানি সুন্দরভাবে পার হয়ে যাবে।
নদীর দখল-দূষণ ঠেকানোর নির্দেশ : দেশের নদ-নদীগুলোর দখল ও দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। সম্মেলনে নৌপরিবহন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কার্য-অধিবেশন মন্ত্রী এই নির্দেশ দেন।
সরকারি দলের কেউ ডিসিদের কাজে হস্তক্ষেপ করে না : সরকারি দলের কেউ ডিসিদের কাজে হস্তক্ষেপ করে না বলে দাবি করেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ। ডিসি সম্মেলনের শেষদিনের তৃতীয় কার্য-অধিবেশন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
সরকারি দলের নেতাদের হস্তক্ষেপে অনেক স্থানে ডিসিরা সরকারি বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করতে পারছেন না, এ বিষয়ে তারা কিছু বলেছেন কিনা- জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী বলেন, এটা ঠিক না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস সরকারি জমিতে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শামসুর রহমান বলেন, ‘যদি সেরকম কিছু থাকে তবে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’
jugantor