বিশেষ প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর পবার শাহপুর থেকে হরিয়ান বিল পর্যন্ত খালটি খনন করছে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। দরপত্রের নিয়ম অনুযায়ী খালটি সর্বনিম্ন তিন ফিট থেকে ৯ ফিট পর্যন্ত খনন করার কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোথাও তিন ফিটও পরিমাণও খনন করা হয়নি বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। ভরা বর্ষায় কোনো মতে দুই ধরের কিছু মাটি ও ময়লা-আবর্জনা সরিয়ে দিয়েই খাল খননের নামে তামাশায় মেতে উঠেছেন ঠিকাদাররা। এরই মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ কাজও শেষ করেছেন এমন জোড়া-তালি দিয়ে। আবার দু’জন ঠিকাদার এরই মধ্যে সব বিলও তুলে নিয়েছেন। কিন্তু বর্ষার পানিতে খালের পাড়েই ফেলে রাখা মাটি ও ময়লা-আবর্জনা নেমে গিয়ে আবারো অনেকাংশেই ভরাট হয়ে গেছে খালটি। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝে। এভাবে শুধু পবার এই খালটিই নয়, এমন আরো তিনটি খাল খননের নামে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রয়াত্ব প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের দাবি, ভরা বর্ষার মধ্যে খাল খননের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা তোছরুপে নেমেছে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে খাল খননের লিজ পাওয়া ঠিকাদারদেরও পোয়াবারো অবস্থা বিরাজ করছে। খাল খননের নামে ১৭ কোটি টাকার মধ্যে অধিকাংশ টাকাই লুটপাট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আবার ঠিকমতো খাল খনন না হওয়ায় পুরো টাকাই গোচা যাবে বলেও দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ১২ কিলোমিটার খালটি দীর্ঘদিন ধরে ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি হয়ে পদ্মার সঙ্গে সম্পূর্ণ পানি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে খালটি খননের উদ্যোগ নেয় বিএমডিএ। খালটি খননের জন্য দরপত্রের মাধ্যমে ১০টি গ্রুপে ১০ জন ঠিকাদার নির্বাচন করে বিএমডিএ। ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে গত মে মাস থেকে শুরু থেকে হওয়া এ কাজের জন্য এরই মধ্যে ২ জন ঠিকাদারকে বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী স্থান ভেদে ৩-৯ ফিট গভীরতায় খালটি খননের কথা বলা হলেও সেটির ধারে-কাছেও যেতে পারেনি ঠিকাদাররা। কোথাও এক ফিট আবার কোথাও দুই ফিট, কোথাও কোনো প্রকার খনন করেই শুধুমাত্র ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার করেই কাজ শেষ করা হয়েছে। এইভাবে খালটির প্রায় ৭০ ভাগের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজটুকুও কয়েকদিনে মাথায় শেষ হবে জোড়া-তালি দিয়ে।
একদিকে, একদিকে খাল কোনমতে কেটে মাটি ও ময়লা-আর্বজনাগুলো তুলে পাড়েই ফেলার কারণে বর্ষার পানিতে সেগুলো আবারো খালেই গিয়ে পড়ে ভরাটও হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। পবার হরিয়ানের বেশকিছু অংশে এ অবস্থা দেখা গেছে। আবার কাটাখালি বাজারের কাছে কোনো মতে, বাজারের ময়লা-আবর্জনা তুলে নিয়েই খাল খননের কাজ শেষ করা হয়েছে। এভাবে গোটা খালটিতেই খননের নামে চালানো হয়েছে লুটপাট।
স্থানীয় বাসিন্দা আকরাম হোসেন বলেন, ‘ভরা বর্ষায় খাল খননের নামে ব্যাপক হরিলুট করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বিন্দুমাত্রও খনন করা হয়নি। আবার কোথাও খালের মাটি খালেই রেখে দেওয়া হয়েছে। এতে করে বর্ষার পানিতে ওই মাটি ও ময়লা-আবর্জনা আবার খালে গিয়ে পড়ে ভরে গেছে। ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ ট্যাকা গোচ্চা যাওয়া ছাড়া এই খাল খনন করে এলাকাবাসীর কোনো কাজেই দিবে না।’
হরিয়ান এলাকার আরেক বাসিন্দা আজমল হোসেন বলেন, ‘খাল খননের নামে সাধারণ মানুষের ক্ষতিই করা হয়েছে। নিচে গভীল না করে খালের পাড়ের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিও কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে কারো কারো বাড়ি-ঘর হুমকিরমুখে পড়েছে। কিন্তু নিচে কোথাও তিন ফিট গভীর করে কাটা হয়নি। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে চরম ক্ষোভ আছে। মানুষের ক্ষতি করার জন্য বিএমডিএ’র কর্মকর্তাদের অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।
অন্যদিকে চারঘাটের মেরামতপুর-কাঁকড়ামারি আড়াই কিলোমিটার খাল, বাঘার ব্যাঙ্গাড়ী-চাঁদপুর ৩৮৫ মিটার খাল ও বাঘার নওটিকা-মোর্শেদপুর ১১ কিলোমিটার খাল খননেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মের অভিযোগ নওটিকা-মোর্শেদপুর খালটির প্রায় আড়াই কিলোমিটার অংশ কাজ বন্ধই করে দিয়েছেন এলাকাবাসী।
ওই এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কোথাও ঠিকমতো খাল খনন করা হয়নি। বর্ষার মধ্যে খাল খনন করার ঘটনা এবারই দেখলাম। এ কারণেই খননের নামে যাচ্ছে-তাই ভাবে কেটে পুরো টাকা লুটপাটের ফন্দি করা হয়েছে।
এদিকে বিএমডিএ’র রাজশাহী সদর দপ্তরের প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে সর্বমোট ২৭ কিলোমিটার খাল খননের জন্য এবার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অধিকাংশ কাজই শেষ করে বিলও প্রায় পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বোচ্চ বিল বাকি রয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
বিএমডিএ’র একাধিক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট একাধিক ঠিকাদাররা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিটি গ্রুপের কাজেই খাল খননের নামে হরিলুট করা হয়েছে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই হরিলুটের জন্য কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা অন্যদের কাছে গড়ে এক কোটি টাকার কাজ অন্তত ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে বিক্রি করে দিয়ে অন্যজনকে দিয়ে করে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এভাবেই খাল খননের কাজ কেনা-বেচা হয়ে পরে নামেমাত্র খননের মাধ্যমে প্রায় ৮০ ভাগ টাকাই তোছরুপ করা হয়েছে।
ঠিকাদাররা আরো জানান, বিএমডিএ’র আওতায় প্রতিটি খাল খননের বিষয়টি তদন্ত করে দেখা দরকার। তাহলে এর পেছনে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ তোছরুপ করা হয়েছে, সেটি বের হয়ে আসবে। পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে।
তবে খাল খননের নামে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেছেন এ প্রকল্পের পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী নাজিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি অধিকাংশ এলাকাই পরিদর্শন করেছি। কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে কোনো কোনে জায়গা মাটি কাটা যায়নি এটা ঠিক। সে কারণে প্রকল্পের কাঠামো আমরা পরিবর্তন করেছি। কিন্তু অনিয়ম হয়নি।’
এভি-১ এসএল