তুমি টেনশন করো না, বাবা।

‘তুমি টেনশন করো না। আমরা ভালো আছি।’ রফিকের ছোট মেয়ে বলছে সরাসরি ভিডিও কলে। গত তিন মাস বেতন হচ্ছে না রফিকের। টেনে টুনে বন্ধুদের সাহায্যে চলছে কোনো রকম। এখানে ঘর ভাড়া বাকি পড়েছে। এই ব্যয়বহুল অভিজাত শহরে ঘর ভাড়া, খাওয়ার খরচ, মোবাইল খরচ, গাড়িভাড়া—জীবন চালানো চাট্টিখানি বিষয় নয়!

ছোট মেয়ে পাখি এবার ক্লাস ফাইভে। অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। মেয়ের কথায় চোখ ভিজে ওঠে রফিকের। মোবাইল স্ক্রিন থেকে মুখ সরিয়ে নেয় রফিক।
পাখি বুঝতে পারে বাবা কাঁদছে। বলে, তুমি কাঁদছ কেন?
রফিকের মুখ থেকে কোনো কথা আসে না। গলাটা বন্ধ হয়ে আসে। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে এমনটা হয়নি। এবারই প্রথম। কোম্পানির বেশ কয়েকটা বিল আটকে গেছে। কোম্পানিও নিরুপায়। প্রতি রোজার ঈদে রফিকের বাবার কাছে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র আত্মীয়স্বজন আসে জাকাত ফিতরা নেওয়ার জন্য। এবারও আসছেন। রফিকের বাবা ভাবেন কী করে সম্ভব, এত দিন বেতন ছাড়া থাকে কি করে? এবার ধার করেই হবে জাকাত। রফিক শুধবে পরে।
বাড়িতে অসুস্থ বাবা–মা। গত মাস পর্যন্ত স্ত্রী–সন্তান ও বাবা মায়ের খরচের টাকা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পাঠিয়েছে সময় মতো। ইতিমধ্যে কয়েক বন্ধু ঈদ করতে বাড়িতে গেছেন। যে দু–একজন আছেন তাদের কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। তারপরও যৎ সামান্য তারাও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু এভাবে কত দিন। নানা ভাবনায় রফিকের ঘুম আসে না।
রফিকের স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নতুন চাকরি। যা পায় তা পরিবারের মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশ। এ টাকায় সংসার চালানো কষ্টকর। সাতাশ রমজান শেষ হয়ে আটাশ রমজানের সাহ্‌রির সময়। সারা রাত ঘুম হয়নি রফিকের। রফিকের বড় মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। সাহ্‌রির সময় প্রায় কল আসে ইমোতে। সাহ্‌রি খাবারের দৃশ্য ভাগাভাগি করে তারা। ইফতারেও ব্যতিক্রম হয় না। তারাবির নামাজের পর গল্প হয় ফেসবুক মেসেঞ্জারে ভিডিও চ্যাটে।
পাখি জানতে চায়, আব্বু ঈদের জন্য পাঞ্জাবি নিয়েছ। নারে মা, উত্তর দেয় রফিক। পাখির বড় বোন বন্যা এসে একই প্রশ্ন, কি নিয়েছে ঈদে। রফিক বলে তোরা আমার পিছে পড়লি কেনরে মা। আমি ভাবছি তোদের কথা, এই প্রথম তোদের ঈদে কিছুই দিতে পারলাম না।
পাখি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, আব্বু, এবারের ঈদে আমাদের কিছুই চাই না। প্লিজ তুমি একটা কিছু নাও। প্লিজ, প্লিজ। মেয়েটা ওর মায়ের মতো প্লিজ শব্দটা খুব দরদ দিয়ে বলে।
রফিক বলে, মা, বাংলাদেশে ষোলো কোটি মানুষ। তার মধ্যে কত মানুষ খেতে পায় না। কত মানুষের ঘর নাই। ফুটপাত, স্টেশন, রাস্তায় থাকে। কত মানুষ বস্তিতে থাকে। অনেকের ঘর আছে বাজারের খরচ নাই, কাউকে বলতে পারে না। অভাব দারিদ্র্যর অনেক প্রকারভেদ, আমাদের সমস্যা সাময়িক। একটা পাঞ্জাবি, জামা, এ গুলোতে ঈদের খুশি আটকে থাকে। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে মিলন। ঈদ মানে ঈদের নামাজে সমবেত হওয়া, ঈদ মানে গুরু জনের কদমবুচি। ঈদ মানে…।
রফিকের বড় মেয়ে বন্যা তার কথা শুনছিল। বলল, আব্বু, ঈদ মানে মিলন। আমরাতো এতই হতভাগ্য তোমাকে মোবাইলে দেখি আজকাল। গত তেরো বছরে দুই–তিনটা ঈদে পেয়েছিলাম হয়তো, সে ইদগুলি কত আনন্দের ছিল। তুমি আমাদের ঈদি দিতে, সারা বাড়ির ছেলেমেয়েরা আসত তোমার কাছে। আমার কী যে ভালো লাগত। আম্মু আমাদের জামা কাপড় দিয়েছে। ঈদে না দিক অন্য সময় দিয়েছে। আসলে ঈদের সময় নতুন কিছু পেতে ভালো লাগে এই যা। তোমারতো সেই পুরোনো প্যান্ট আর শার্ট। তুমি না থাকলে ঈদ, ঈদ মনে হয় না, ঈদের দিনে দাদুর চোখে পানি থাকে, আম্মু থাকে উদাস, আনমনা। পাখি বলে এমন চাকরি করো কেন? চলে এসো।
রফিক অনেকের চেয়ে আলাদা একজন মানুষ। এক সময় বাবা–মায়ের কাছে লুকাত না কিছু। এখন সন্তানদের কাছেও গোপন করে না। কারণ নিজের রক্তের কাছে লুকানোর কিছু নেই। সুখ–দুঃখ ভাগাভাগি করে সত্য জেনেই সন্তান বড় হবে।
বন্যা রফিককে বলে, আব্বু, এখন কি সময় আছে, কুরিয়ার করে তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি পাঠিয়ে দিই। ছোট মেয়ে কেঁদে ফেলে, রফিকের স্ত্রী বুকে তুলে নেয় পাখিকে।
রফিকের মন মানে না। প্রবাসে রফিক চোখ মোছে। দেশে স্ত্রী আর দুই মেয়ে। দুদিন পর ঈদ।
জেলা শহর থেকে কাল ওরা গ্রামে যাবে ঈদ করতে। দাদা দাদুর কাছে।
কোনো এক চাপা কষ্ট বুকে চেপে ধরে রফিকের। বিশ্বাস ছিল ঈদের আগেই অন্তত এক মাসের বেতন হবে। নিজেকে খুব ছোট মনে হয় রফিকের।
আদুরে মেয়েদের কথা মনে পড়ে বারবার। বড় মেয়ে কুরিয়ার করে পাঞ্জাবি পাঠাতে চায়। তাকে রফিক বলেছে এখন ঈদের সময় হাতে মাত্র দুদিন, পারবে না আম্মু। তুমি টাকা কোথায় পাবে। বন্যা জানায় তার বৃত্তির টাকা রাখা আছে মায়ের কাছে। ছোট মেয়ে পাখি বলেছে, এবারের ঈদে কিছুই লাগবে না, রফিক যেন টেনশন না করে।
রফিক অশ্রুসিক্ত নয়নে হাসে? কী ভাগ্যবান সে! তার মেয়েরা তাকে কত ভালোবাসে। বেতন না হওয়ায় এবারের ঈদে মেয়েরা নতুন জামা পরতে পারবে না। অথচ কতজন ভাবে রফিক অনেক দিন বিদেশ করে নিশ্চয়ই লাখ লাখ টাকার মালিক। প্রবাসে যেন টাকা ওড়ে। প্রবাসীর কষ্ট শুধু প্রবাসীই বোঝে।

Next Post

যাকাত নিতে গিয়ে তীব্র গরমে স্ট্রোকে ২ জন মারা গেছে।

শুক্র জুন ১৫ , ২০১৮
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে তীব্র গরমে স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে দু’জন মারা গেছেন। চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও কয়েকজন। শুক্রবার (১৫ জুন) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ বিশ্বাসের বাড়ি থেকে জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যান ওই দু’জন। বেলকুচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিক্যাল অফিসার […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links