ava desk :ট্রাম্প-কিম সম্মেলনের পর দ্বিতীয় আরেকটি তাক লাগানো ঘটনা ছিল পুতিন-ট্রাম্প বৈঠক। সারা বিশ্বের চোখ ছিল সেদিকেই। ভালোয় ভালোয় সেটাও শেষ হল সোমবার। লাভ-ক্ষতি, হার-জিতের প্রসঙ্গ পরের কথা। দুই মেরুর দুই মোড়ল মুখোমুখি বসেছেন। চিরশত্রুরা এক টেবিলে- বিশ্ব কূটনীতিতে এটুকু কম কথা নয়। অনুমান-অনুকম্পা যাই থাকুক, বৈঠকের শুরুটা ছিল ‘মন্দের ভালো’। দুই নায়কের আগবাড়ানো হাত মেলানোর মধ্য দিয়ে শুরু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঐতিহাসিক বৈঠক। ধরাবাধা-নির্ধারিত কোনো কর্মসূচি ছিল না। ট্রাম্প আগেই বলেছিলেন, বৈঠক হবে একা একা। কথা হবে শুধু দু’জনার। আর কি কি বিষয়ে কথা হল- বৈঠকের পরই সব জানাব। বৈঠক নিয়ে দু’পক্ষের কারও চাওয়া-পাওয়াও তেমন ছিল না। ট্রাম্প তো গোড়াতেই স্বীকার করেছেন যে, সীমিত আশা নিয়ে বৈঠকে বসছেন তিনি। কিন্তু পুতিন তার কথায় বাদ সাধেন। কূটকণ্ঠে বলেন, আমরা সম্পর্ক উন্নয়নের জোর আশা নিয়ে এসেছি। ট্রাম্পও এ কথায় প্রাণ ফিরে পান। পুতিনের কথার সুর ধরেই বৈঠকের শুরুতে ট্রাম্প বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়া ভালো বিষয়, খারাপ কিছু নয়। আমি মনে করি আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব দেখতে চায় গোটা বিশ্ব।’ তবে কথায় কথায় একটা বেফাঁস কথাও বলে ফেলেছেন পুতিন। হয়তো দেশে ফিরে এর রেশ পোহাতে হবে ট্রাম্পকে। তা হল- যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময় নাকি ট্রাম্পই প্রেসিডেন্ট হোক, এটাই চেয়েছিলেন পুতিন। এমনিতেই নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে জ্বালায় আছেন ট্রাম্প। তার ওপর পুতিনের এ সরল স্বীকারোক্তির আগুনে এবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে পারে হিলারি শিবির।
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে সোমবার প্রথমবার মুখোমুখি বৈঠকে বসেন ট্রাম্প ও পুতিন। বৈঠক শুরু হওয়ার কথা ছিল স্থানীয় সময় বেলা ১টায় (বাংলাদেশ সময় ৪টায়)। নির্ধারিত সময়ের ১ ঘণ্টা পর দুপুর ২টা ১০ মিনিটে শুরু হয় বৈঠক। প্রায় দেড় ঘণ্টার একান্ত নিভৃতে এ বৈঠকে দুই দোভাষী ছাড়া কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কোনো সহযোগীর উপস্থিতি চাননি ট্রাম্প। বৈঠকের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার খোরাক না বানাতে আগেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
সন্ধিতে এসেও পুরাতন রেষারেষি চালিয়ে গেছেন বিশ্বের দুই প্রভাবশালী নেতা। শুরুটা করলেন পুতিন। মান ধরে রাখতে শেষে নামলেন ট্রাম্প। রোববার রাতেই হেলসিংকিতে পৌঁছে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পুতিনের অপেক্ষায় পুরো এক রাত থাকেন হেলসিংকির হিলটন কালাসতাজানত্রপ্পা হোটেলে। পুতিন পৌঁছান রাত পেরিয়ে সোমবার বৈঠক শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে। তবে সভাস্থলে তিনি ট্রাম্পের আগে যান। পুতিনকেও পাল্টা অপেক্ষায় রেখেছিলেন ট্রাম্প। প্রায় আধা ঘণ্টা দেরিতে বৈঠকস্থল ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌঁছান তিনি।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, বিশ্বনেতাদের অপেক্ষায় রাখাটা পুতিনের প্রভাব প্রদর্শনের পুরনো স্টাইল। শীর্ষস্থানীয় কোনো নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষেত্রেও এ স্টাইল ছাড়তে পারেননি পুতিন। পোপের সঙ্গে দু’বার বৈঠকে ঘণ্টাখানেক দেরি করে সভাস্থলে পৌঁছানোর রেকর্ড রয়েছে তার। ২০১৬ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে ২ ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন পুতিন। এমনকি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকে দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা বিলম্ব করিয়েছিলেন তিনি।
পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেয়ার বিষয়ে ঘরে-বাইরে দু’দিক থেকেই চাপের মুখে ছিলেন ট্রাম্প। দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের শুরুতে ৩ সেকেন্ড পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। শুরুতেই ট্রাম্প সফলভাবে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের জন্য পুতিনকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, ‘সত্যিই চমৎকার একটি বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য আমি আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে চাই, এটি অন্যতম সেরা আয়োজনগুলোর একটি ছিল।’ পুতিন বলেন, ‘শান্তির এ দেশে মিলিত হতে পেরে আমি আনন্দিত। আমরা আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত রাখব। আমরা ফোনে কথা বলব। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশে সাক্ষাৎ করব। কিন্তু অবশ্যই এখনই সময় আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করার। বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলার।’
ট্রাম্প ও পুতিনের বৈঠক চলাকালে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভ। পরে ট্রাম্প ও পুতিনসহ আলোচনায় বসেন দুই দেশের ১২ নেতা। মধ্যাহ্নভোজের মাঝে আলোচনা সেরে নেন তারা। সেখানে ট্রাম্প বলেন, রুদ্ধদ্বার প্রথম এ আলোচনার ‘শুভ সূচনা’ হয়েছে। বৈঠককে দু’দেশের জটিল সম্পর্ক বন্ধুত্বে পরিণত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে মনে করেন পুতিন। বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তবে বাণিজ্য থেকে শুরু করে সামরিক, ক্ষেপণাস্ত্র, পরমাণু ও পরস্পরের বন্ধু চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানায় ওয়াশিংটনের রুশ দূতাবাস। মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলবেন বলে আগেই জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। এছাড়া ইউক্রেন, সিরিয়া, কোরীয় উপদ্বীপ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠক শেষে যৌথ এক সংবাদ সম্মেলন করেন ট্রাম্প ও পুতিন। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জটিল কোনো কারণ নেই। বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রুশ হস্তক্ষেপের বিষয় তোলেন বলে জানান পুতিন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাকে আবারও বলেছি যে, রাশিয়া কখনও হস্তক্ষেপ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কোনো পরিকল্পনা মস্কোর ছিল না, এখনও নেই।’ নির্বাচনে রুশ সংযোগ নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে পুতিন আরও বলেন, ‘আপনারা কিভাবে ভাবলেন যে, ট্রাম্প আমাকে বিশ্বাস করবে আর আমি তাকে বিশ্বাস করব। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হোক আমি শুধু এটাই চেয়েছিলাম।’ সন্ত্রাস দমন ও সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান রুশ প্রেসিডেন্ট।
সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টার গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক কখনও খারাপের দিকে যায়নি। দু’দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের পর আজ থেকে বিশ্ব নতুন সম্পর্ক দেখবে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সিরিয়ায় বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছে। পুতিনকে ‘দক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী’ উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন ট্রাম্প। এর আগে ওয়াশিংটন-মস্কো সম্পর্কের টানাপোড়েনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করেছেন ট্রাম্প। হেলসিংকিতে বৈঠক শুরুর ৪ ঘণ্টা আগে তিনি এমন অভিযোগ তোলেন। মস্কোর সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততার জন্য ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটিকে দায়ী করেন ট্রাম্প। সোমবার টুইটারে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কখনোই এত বাজে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বছরের বোকামি ও নির্বুদ্ধিতাকে ধন্যবাদ। এখন যা হচ্ছে সব পাতানো ষড়যন্ত্র (উইচ হান্ট)।
jugantor