ava desk: দেশে দুটি প্রফেশন যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, দুই পেশাই জিতে যায়, কিন্তু হেরে যায় দেশ, হেরে যায় পুরা জাতি। আর কাউকে পরাজিত করা অনেক সহজ, কিন্তু জয় করা? খুবই খুবই কঠিন।
ডাক্তার ও সাংবাদিক এক পেশাজীবী আরেক পেশাজীবীকে জয় করতে হবে, পরাজিত করা নয়। আমি ডাক্তার হলেও অনেক অনেক কাছের মানুষগুলো সাংবাদিক। আর ২০০৯ সালে ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে আমি নিজেও সাংবাদিকতার ছয় মাসের সার্টিফাইড কোর্স করেছিলাম।
এখন শিশু রাইফার অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু নিয়ে ডাক্তার ও সাংবাদিকদের মাঝে এক ধরণের বিরোধিতা শুরু হয়েছে। ফেসবুকে পরস্পরকে আক্রমণ করে অনেকে আবেগে নানা কথা বলছেন। এসব আরও কয়েকদিন চলবে। অতঃপর ধীরে ধীরে সবার আবেগ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। উত্তেজনা, ঘৃণা, ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যাবে।
শেষমেশ, ডা. মুরাদ ভাইয়া এবং ডা. সাদিয়া আপুর নির্মম খুনের ঘটনা, কিংবা মৃত রাইফা বা অন্যান্য রোগীদের মারা যাওয়ার ঘটনাগুলোও আমার আপনার কাছে নিছক একটি পরিসংখ্যানে পর্যবসিত হবে।
কিন্তু আমাদের করণীয় কি কিছু নেই?
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করুন।
এক. চলমান সংঘাতের মূল কারণ – demoralization. এটি আমাদের রাষ্ট্রে বা সমাজের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটা সমাজের সামগ্রিক demoralization এরই একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। একটা সমাজ যখন ভাঙ্গনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, তখনই সমাজের বিভিন্ন অংশগুলি একটি অন্যটির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। আমাদের সমাজে সেটাই ঘটছে কিন্তু।
দুই. চলমান সংঘাতের মূল কারন হচ্ছে বিশ্বাস করার মত আশ্বাস এবং আশ্বাস পাওয়ার মত বিশ্বাসের যে অভাব। যেটাকে আমরা poor doctor patient relationship বলি। অন্য কথায় breach of faith in doctor patient relationship। এটা হচ্ছে সমাজে বিদ্যমান মানুষে মানুষে, পেশাজীবী– পেশাজীবীতে যে সামগ্রিক আস্থার সঙ্কট চলছে সেটারই উপসর্গ।
তিন. ডাক্তারদের একটা সত্যিকারের প্রফেশনাল অর্গানাইজেশান এখনো আমাদের দেশে নেই। একটা প্রফেশনাল অর্গানাইজেশান অন্যান্য দেশে যে ভূমিকা পালন করে সেটা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। তথাকথিত প্রফেশনাল সংগঠনগুলি কিন্ত কমবেশি পলিটিক্স নিয়ে ব্যস্ত।
চার. দুই পক্ষকে এই রকম অলআউট অ্যাটাকে নামিয়ে দেওয়ায় কার লাভ হচ্ছে সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে চিকিৎসার জন্য আমাদের দেশ থেকে বিদেশে রোগীদের গমন (মেডিকেল ট্যুরিজম) অনেক কমে গেছে। একান্ত যাদের হামবড়া ভাব এবং যেসব রোগের সমাধান আসলেই নেই সেটা ছাড়া বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। হেলথ ট্যুরিজম বাড়ানোর জন্য আমাদের মেডিকেল ব্যবস্থার প্রতি সাধারন মানুষের আস্থার সংকট তৈরি যেন না হয় সেই ব্যাপারে কিন্তু আমাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারছি না।
পাঁচ. ভাল খারাপ সব পেশার মধ্যেই আছে, ডাক্তারদের মধ্যেও খারাপ ডাক্তার আছেন, আবার সাংবাদিকদের মধ্যেও খারাপ সাংবাদিক আছেন। এক এক ঘটনার ক্ষেত্রে কেইস সামারি এক এক রকম। কোথাও ঘটনার জন্য সাংবাদিক দায়ী, আবার কোথাও ডাক্তার দায়ী। আমাদের খারাপ ঘটনাগুলো ওই খারাপ দুইটা মাইনরিটির ইনভলবমেন্টের জন্যই কি না – এটা খতিয়ে দেখতে হবে।
চিকিৎসা ব্যবস্থার কয়েকটি প্রধান সমস্যার প্রতি আলোকপাত করছি।
১. মিডিয়া পলিসি একটা বড় প্রবলেম। যেমন কুকুর মানুষকে কামড় দিলে সাংবাদিকতার নিয়মানুযায়ী সেটি কোন নিউজ না, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড় দিলে সেটা হেডলাইন। একইভাবে “ডাক্তাররা সার্ভিস দিবেন, দায়িত্বশীলতা নিয়ে কাজ করবেন, রোগী বাঁচাবেন, রাত জেগে সার্ভিস দিবেন এটা তো বাই ডিফল্ট জব, এবং এটা কোন নিউজ হবে কেন? এর উল্টা হলেই সেটাই বরং নিউজ হবে” এই ফিলসফির সংস্কার জরুরি। সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে পাবলিক ইন্টারেস্টের পাশাপাশি কমিউনিটি ইন্টারেস্ট ও বড় ধরণের বিবেচ্য বিষয়।
২. আমাদের সাধারণ জনগণের মধ্যে রোগ সম্পর্কে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব আছে। মিডিয়াতে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম হলেও এখনো এটা আপ টু মার্ক না।
৩. ডাক্তার, সাংবাদিক সবাই বিভিন্ন political entity তে বিভক্ত হয়ে যাওয়া এবং সে কারণে সত্যিকারের Non – political professional organization গড়ে না উঠায় চিকিৎসা ব্যবস্থার চেক এন্ড ব্যালেন্স হচ্ছে না, হচ্ছে না দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা।
অনেক ডাক্তার এবং সাংবাদিকদের সবচেয়ে খারাপ এবং নষ্ট পেশাজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান। আমি বলব – হ্যাঁ, এই ধরনের অপবাদ দেওয়া খুব সহজ। সাংবাদিকদের মধ্যে politics আছে, তাদের মধ্যে clash আছে, হলুদ সাংবাদিকতা আছে। কিন্তু সাগর – রুনির বিচারের দাবীতে মোটামুটি সবাই একই platform এ চলে এসেছিল। এমনকি আমি টিভিতে এটিএন বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক এবং এডিটর জ ই মামুনকে দেখেছিলাম – তার কর্তৃপক্ষের (এটিএন চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলতে।
কিন্তু ডাক্তার সমাজে এই ঐক্যটা হয়ত একটু কম। আমাদেরও অনেক সাগর-রুনি ছিল, ডাঃ মুরাদ ভাই এবং ডাঃ সাজিয়া আপুরা (উত্তরায় একটি ক্লিনিকে সিলেট মেডিকেল এর যেই মেধাবী ডাক্তার আপুটাকে রেইপ করার পর হত্যা করা হয়েছিল) ছিল। কিন্তু আমরা এক হতে পারিনি। আমরা এমন কোন নন পলিটিক্যাল প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পাইনি যেখান থেকে আমরা একটি অভিন্ন কর্মসূচির ডাক দিতে পারি। আর এক্ষেত্রে BMA, স্বাচিপ,ড্যাব বা এনডিএফের মত সংগঠনগুলো রিয়েক্টিভ ভূমিকা পালন করলেও প্রোএক্টিভ ভূমিকা কিন্তু রাখতে পারছে না। আর এই না পারার কারন কার্যকর প্রফেশনাল সংগঠনের অনুপস্থিতি।
আবার সাংবাদিকদের প্রফেশনাল অর্গানাইজেশনগুলিও প্রফেশনাল রেসপনসিবিলিটি এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করতে পারছে না। জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা না থাকায়, কমিউনিটি ইন্টারেস্টের চেয়ে চটকদার নিউজই প্রায়োরিটি পাচ্ছে।
ডাক্তার ও সাংবাদিকদের প্রফেশনাল অর্গানাইজেশন যা করবে
১. প্রফেশানের জন্য নিজস্ব কোড অফ কন্ডাক্ট তৈরি। যেমন ডাক্তার – রোগী, ডাক্তার – ফার্মাসিউটিক্যালস, ডাক্তার – ডায়াগনস্টিক সেন্টার ডাক্তার – হাসপাতাল সম্পর্কের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, এক কথায় National guideline for Medical Laws & Ethics তৈরি করা।
জাতি আমাদের কাছ থেকে এই ব্যাখ্যা আজ হোক কাল হোক চাইবে– আমাদের বার্ষিক ইনভেস্টিগেশন কস্টের ৭৩০ কোটি টাকার (দৈনিক ২ কোটি টাকা) কত অংশ ডাক্তাররা পান, আর কত অংশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার পান, আর কত অংশ রোগীরা ছাড় পান। এই টাকার যত অংশই ডাক্তাররা পান না কেন, নিজেদের আরও transparent রাখার জন্য এই ব্যাপারগুলো জাতির কাছে ক্লিয়ার করতে হবে।
আমাদের বার্ষিক ওষুধ ব্যবসার (এ জাতি কর্তৃক এক বছরে কেনা ঔষধের মূল্য) ১০ হাজার কোটি টাকার কত অংশ কত অংশ ডাক্তাররা পান, আর কত অংশ ফার্মাসিউটিক্যালসরা পান – এটা ও জাতি আমাদের কাছ থেকে জানতে চাইতে পারে।
আমরা ভাল করেই জানি, হাসপাতাল ব্যবসা বলেন আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা, কোনটারই মূল সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা ডাক্তাররা নন। ডাক্তারেরা যেটা পান সেটা মূল ব্যবসার আইসবার্গ মাত্র। আর এই বিষয়গুলিই জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেন দায়িত্বশীল সাংবাদিকরা।
২. ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু – এই সব কথা কোনোভাবেই নন ডাক্তাররা বুঝতে পারেন না? ভুল চিকিৎসা হয়েছে কি না – এটা যাচাই করতেই তো কমপক্ষে একাধিক ডাক্তার দরকার। হুটহাট তদন্ত ব্যতিরেকে এই ধরনের কথা যেন কেউই না বলে সে জন্য আইন দরকার। ডাক্তার – আইনজীবী – সাংবাদিক এবং প্রশাসন সমন্বয়ে যৌথ টাস্কফোর্স বা সার্ভিল্যান্স টিম গঠন করতে হবে।
কোথাও ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলে সেক্ষেত্রে এই যৌথ টাস্কফোর্সের তদন্ত ছাড়া কেউ যেন মতামত দিতে না পারে – সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এই টাস্কফোর্স সবাইকে নিয়েই যেহেতু সমাজ, তাই মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমই দরকার। সবাইকে নিয়েই আমাদের চলতে হবে, সমাজ থেকে কোন একটি পেশাজীবীকেও আমরা ডিলিট করে দিতে পারি না। এই মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের সমন্বয় আর যৌথ বিবৃতি ভুল বোঝাবুঝি কমে আসবে শূন্যের কোটায়।
৩. ডাক্তার এবং সাংবাদিক উভয়েরই নিজস্ব প্রফেশনাল লেজিসলেটিভ বডি গঠন করা হোক – যেখানে কোন ডাক্তার Malpraxis করলে তাকে রাষ্ট্র বা সমাজ শাস্তি দেওয়ার আগে আমাদের self – correction বা নিজেদের সংশোধনের কাজ করতে হবে, প্রয়োজনে জরিমানা, শাস্তি প্রভৃতি করে আমাদেরকে সমাজের কাছে নিজেদের আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।
আবার সাংবাদিকদের নিজস্ব প্রফেশনাল লেজিসলেটিভ বডি দায়িত্বহীন সংবাদের জন্য সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে জরিমানা, শাস্তির মাধ্যমে সমাজের কাছে সাংবাদিকতার মহান পেশাকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।
৪. Medical Ethics, Doctor – Patient Relationship, Patient Counseling, Behavioral Science, patriotic journalism, Social journalism – এই সব ব্যাপারে নিয়মিত সিম্পোজিয়াম, সেমিনার, ওয়ার্কশপ আয়োজন এবং নতুন ডাক্তার এবং নবীন সাংবাদিকদের মধ্যে নিয়মিত সচেতনতা সৃষ্টি এবং ক্লাস নিতে হবে। এই বিষয়গুলির ওপর শর্ট বা লং কোর্স চালু করার পরিকল্পনা নিতে হবে।
৫. ডাক্তারদের নিজস্ব মিডিয়া দরকার। ডাক্তারদের টাকা কম না, অথচ নিজস্ব কোন মিডিয়া নেই। এমন কিছু ইন্টারনেট সাইট থাকতে হবে যেগুলোর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে রোগসমূহের ব্যাপারা জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে।
মানুষ যখন জানবে Brain stem hemorrhage এর রোগী সাধারণত survive করে না, তখন তাদের কেউ Brain stem hemorrhage এ মারা গেলে “ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু” টাইপের ফালতু দাবি অন্তত করবে না। অন্ততপক্ষে ৫ জন দারি করলেও ১০ জন সেটার বিরোধিতা করবে।
jugantor