এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী তো চীনই। সেই সোভিয়েত নেই বলে কি স্নায়ুযুদ্ধ মহাকাশে বিস্তৃত হবে না!

আভা ডেস্কঃ চলতি মাসেই মানুষের চন্দ্রাভিযানের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অ্যাপোলো-১১ এখন থেকে ৫০ বছর আগে জুলাই মাসেই চাঁদে অবতরণ করেছিল। ওই চন্দ্রাভিযান নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, এ বছর সারা বিশ্বই ‘সফল’ ওই অভিযানের ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করবে। করবে না-ই বা কেন? পৃথিবীর মানুষের কাছে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে এরপর এমন কোনো সফল অভিযানের খবর তো আসেনি আর। ১৯৭২ সালের পর মনুষ্যবাহী আর কোনো মহাকাশযান এত বড় অভিযানে যায়নি। কিন্তু এ বছরই এতে পরিবর্তন আসছে বলে মনে হচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম মাসেই চীনের একটি মহাকাশযান চাঁদ ঘুরে এসেছে। শুধু ঘুরে এসেছে বললে ভুল হবে, চন্দ্রপৃষ্ঠের সবচেয়ে দুরূহ স্থানে মহাকাশযানটি অবতরণ করেছে বলেও দাবি করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের নড়চড়ে বসার জন্য এটুকু তথ্যই যথেষ্ট ছিল। কারণ, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী তো চীনই। সেই সোভিয়েত নেই বলে কি স্নায়ুযুদ্ধ মহাকাশে বিস্তৃত হবে না!

গত জানুয়ারিতে চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন (সিএনএসএ) ঘোষণা করে, পৃথিবী থেকে চাঁদের যে পাশটি দেখা যায় না, সে পাশেই তাদের পাঠানো মহাকাশযান চ্যাং’ই-৪ অবতরণ করেছে। চীনা পুরাণ অনুযায়ী চন্দ্রদেবী চ্যাং’ই-এর নামধারী এ মহাকাশযান অবতরণের খবরের পরই নড়েচড়ে বসে বিশ্ব। কারণ এটি চাঁদের সেই পৃষ্ঠে অবতরণ করেছে, যেখানে পৃথিবী থেকে পাঠানো রেডিও সিগন্যাল ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারে না। উপরন্তু ওই পৃষ্ঠ অনেক রুক্ষ, যেখানে এত উঁচু পর্বত রয়েছে, যা পৃথিবীর মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। চ্যাং-ই-৪ কতটা দুরূহ স্থানে অবতরণ করল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চ্যাং’ই-৪ নামের একটি মহাকাশযান চাঁদে অবতরণ করেছে, যা চীন পাঠিয়েছে। অর্থাৎ ২০০৭ সালে চাঁদে ঘাঁটি স্থাপনের যে পরিকল্পনা চীন করেছিল, সে পথে দেশটি অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

শুধু চীন কেন, মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্কার জানাচ্ছে, চাঁদ নিয়ে হালে আরও অনেকেই মেতেছে। চাঁদ এখানে উপলক্ষ মাত্র, মূল হচ্ছে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার। ইসরায়েলের কথাই ধরা যাক। ইসরায়েলের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান স্পেসআইএলের পাঠানো একটি মহাকাশযান চাঁদের পিঠে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে গত ১১ এপ্রিল। বিধ্বস্ত হওয়ার আগেই অবশ্য চন্দ্রপৃষ্ঠে ছবি তুলে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে তারা। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চন্দ্রপৃষ্ঠে গিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার জন্য মহাকাশযান পাঠায়নি স্পেসআইএল। বিষয়টিকে ব্যর্থতা বিবেচনা করেই, তারা নতুন অভিযানের কথা ঘোষণা করেছে। একই রকম চন্দ্রাভিযানের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে ভারত। এ বছরই তারা চাঁদের উদ্দেশে পাঠাবে চন্দ্রযান-২। জাপান পিছিয়ে থাকবে কেন? তারাও চন্দ্রাভিযানের ঘোষণা দিয়েছে। তবে তারা চাঁদে অবতরণ করেই খুশি হবে না। তারা চন্দ্রপৃষ্ঠ ঘুরে দেখবে। আগামী বছরই এ অভিযান হওয়ার কথা রয়েছে। একইভাবে চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ) ২০২৫ সালের মধ্যে চাঁদের বরফ খুঁড়ে দেখার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। পুরোনো সমীকরণ অনুযায়ী রাশিয়া তো রয়েছেই। এই যখন অবস্থা, তখন যুক্তরাষ্ট্র আর চুপ থাকে কী করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স গত মার্চেই নতুন চন্দ্রাভিযানের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই মার্কিন মহাকাশচারীরা নতুন এ অভিযান সফল করে দেখাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। কথা হলো, সবাইকে কী তবে একযোগে ‘চাঁদে পেল’? বলা যায়। তবে আগেই বলা হয়েছে যে, চাঁদ আসলে এখানে একটা উপলক্ষ। মূল লক্ষ্য মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার। পেন্সের কথাতেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। গত ২৬ জানুয়ারি নতুন চন্দ্রাভিযানের ঘোষণা দেওয়ার সময় চীন ও রাশিয়াকে ‘প্রতিপক্ষ’ আখ্যা দিয়ে পেন্স বলেন, ‘কোনো ভুল হওয়ার কথা নয় যে, আমরা মহাকাশে আজ লড়াইয়ে অবতীর্ণ, ঠিক যেমনটা ছিল ১৯৬০-এর দশকে।’

পেন্স এখানেই থামেননি। চীন ও রাশিয়া মহাকাশকে অস্ত্রে পরিণত করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে পূর্ণ মাত্রায় অবতীর্ণ হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি। যদিও মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এমন কোনো লড়াইয়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্পেস ডটকমের প্রতিবেদনে। একইভাবে এ ধরনের কোনো প্রতিযোগিতার কথা চীনও অস্বীকার করেছে।

মহাকাশে নতুন প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যাদেরই নাম থাকুক না কেন, মূল খেলোয়াড় এখানে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রই। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের নতুন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ প্রতিযোগিতা আরেকটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতিরই নির্মাণ করতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ ঘোষিত মহাকাশ প্রকল্পগুলোকে বিবেচনায় নিলে বলতে হবে, বিশ্বের শক্তিগুলো এখন আর ভূ-পৃষ্ঠে প্রভাব বিস্তার করেই শান্তি পাচ্ছে না। নিরাপত্তা ও তথ্য প্রশ্নে তারা মহাকাশকে ব্যবহার করতে চাইছে। মহাকাশের সামরিক ব্যবহার ধারণাটি এখন বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এই শব্দের ব্যবহার করেছেন। তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনীর অংশ হিসেবে একটি নতুন ‘স্পেস ফোর্স’ গঠনের কথা বলেছেন। আর ‘স্পাই স্যাটেলাইট’ শব্দটি তো আর নতুন নয়।

কিন্তু এই নতুন প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে বলা যায়। গবেষণা পত্রিকা ফরেন পলিসি জানাচ্ছে, প্রায় দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাকাজে ব্যবহৃত ভূ-উপগ্রহকে শক্তি জুগিয়েছে রুশ আরডি-১৮০ ইঞ্জিন। কিন্তু ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংকট ও ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ প্রশ্নে এই সংযুক্তি থেকে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র এখন মহাকাশে নতুন করে প্রতিযোগিতায় নামার যে পরিকল্পনা করছে, সেখানে রাশিয়ার ওপর তাদের এই দুই দশকের নির্ভরতা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে। এত দিনের সুবিধাটি এখন দায় হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। তাই নিজেদের মহাকাশ গবেষকদের কাজে নামার নির্দেশ দিচ্ছে তারা। রুশ ইঞ্জিনের ওপর থেকে নির্ভরতা দ্রুত কমাতে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই।

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত রকেট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা হতে নিয়েছে। মার্কিন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অন্য দেশের কোনো সরঞ্জাম ব্যবহার না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই মুহূর্তে মহাকাশকেই তাদের ‘একিলিস হিল’ বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনায় এরই মধ্যে যুক্ত হতে চাইছে এলন মাস্কের স্পেসএক্স ও জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন। এ ছাড়া বড় টেক কোম্পানিগুলোরও এদিকে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এরই মধ্যে এ ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি ডলারের বাজেট করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফরেন পলিসি। রাশিয়াও বসে নেই। মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্রুত গতিতে তারা স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। তাদের রয়েছে আরডি-১৮০-এর মতো উচ্চ দক্ষতা ও স্বল্পমূল্যের ইঞ্জিন, যার কোনো প্রতিযোগী এই মুহূর্তে পৃথিবীতে নেই। আর চীন আদতে কী করছে, তা এক বিরাট ধাঁধা। তাদের সর্বশেষ চন্দ্রাভিযানের খবরটি সবাই বিনা বাক্যে গ্রহণ না করলেও উড়িয়ে দিতে পারছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক উচ্চাভিলাষী ঘোষণা ও মহাকাশ গবেষণাকে ‘প্রতিযোগিতা’ আখ্যা দেওয়াটা সত্যিই ১৯৬০-এর দশকের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের এ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিল স্নায়ুযুদ্ধ। অর্থনীতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার অংশ ছিল সেটি। এবারের ঘটনাটিও ভিন্ন কিছু নয়। তফাৎ হচ্ছে, সে সময় পুঁজি ও সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটিও হাজির ছিল, যা এখন নেই। এখন এমন পৃথিবীতে এই দ্বন্দ্বের মঞ্চটি তৈরি হচ্ছে, যেখানে পুঁজিরই রাজ শুধু, যেখানে প্রযুক্তি আরও যোজন যোজন এগিয়ে গেছে। এ অবস্থায় ‘স্টার ওয়ার’-কে আর কল্পনা মনে করা সম্ভব নয়।

প্রথম আলো

Next Post

হাত হারানো শিক্ষার্থী ফিরোজ আজ রামেক থেকে রিলিজ।

রবি জুলাই ১৪ , ২০১৯
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজশাহীতে দুইটি গাড়ির ঘর্ষণে কনুই থেকে ডান হাত হারিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থী ফিরোজ সরদার রামেক হাসপাতাল থেকে রিলিজ (ছুটি) পাবে আজ। তার শারীরিক অবস্থা ভাল হওয়ায় তাকে ছুটি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ রামেক (রামেক) হাসপাতালের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। আজ রোববার দুপুর আড়ায় […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links