নিজস্ব প্রতিনিধি : এক সময়ের বাস হেলপার, পরে ড্রাইভার মনোয়ার হোসেন রাসেল ওরফে চিট রাসেল নামে সমধিক পরিচিত। এখন মাদক সম্রাট বলে খ্যাত। এই চিট রাসেল রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানা পুলিশ ছাড়াও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও র্যাবের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। ইয়াবা ব্যবসার সুবাদে হয়েছেন কোটিপতি। ৫/৭ বছরে ইয়াবার ব্যবসা করে অন্তত ১০/১৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছে মাদক সম্রাট মনোয়ার হোসেন রাসেল ওরফে চিট রাসেল। তার বাবার নাম লুৎফর রহমান। বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা গ্রামে।
গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ১২ টার দিকে নগরীর উপশহর এলাকার রোড নং ৪, ৩ নম্বর সেক্টরের “এভারেস্ট হারমনি” নামের ১৭৭ নং বাসা থেকে প্রায় ৮৮০ পিচ ইয়াবাসহ মাদক সম্রাট রাসেল ও তার স্ত্রী মরিয়মকে আটক করে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে ২০১৬ সালের ৩আগষ্ট বুধবার সকালে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানা এলাকায় টাঙ্গাইলের ইব্রাহিমাবাদ রেলওয়ে স্টেশনের সামনের মহাসড়ক থেকে দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৬০ হাজার পিস ইয়াবাসহ টাঙ্গাইলে র্যাবের হাতে ট্রাকসহ আটক হয়েছিলেন রাজশাহীর মাদক সম্রাট মনোয়ার হোসেন রাসেল। সে সময় এই তার আটকের খবর জানাজানির পর রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও গোদাগাড়ীতে তার এক ডজন সহযোগী গা ঢাকা দিলেও রাসেল জামীনে মুক্তি পেয়ে তাদের সকল ব্যবসায়ীদের নিয়ে আস্তানা করেন নগরীর উপশহর ও তেরোখাদিয়া এলাকায়। তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলা যাবে না। যদি কেউ তার বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে যায় তাকে সে মাদকদিয়ে ফাসিয়ে দেয়। এমনই ঘটনার শিকার হয়েছেন তেরো খাদিয়া এলাকার বাবু নামে এক ব্যাক্তি ।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদক বিরোধী অভিযানে নামলে সে কুরবানী ঈদের আগে উপশহর এলাকার বাসিন্দা এক ব্যবসায়ীকে সাথে নিয়ে ওমরা হজ্জ করতে চলে যান। এর পর থেকে সে গা ঢাকা দিয়ে ছিল।
জানা যায়, রাসেল আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী শহরের তেরখাদিয়া এলাকায় ৫ কাঠা জায়গার ওপর সাত তলা ফাউন্ডেশনে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করছে। বাড়িটি নির্মাণে দামি সব উপকরণ ব্যবহার হয়েছে। এছাড়া নগরীর উপশহর এলাকায় রয়েছে তার আরো একটি সুপরিসর দামি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ২০১৫সালে রাসেল ৭০ লাখ টাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন । তার গ্রাম গোদাগাড়ীর মাটি কাটায়ও জমি-জমা কিনেছেন বিস্তর। এছাড়া ঢাকায় রয়েছে তার দুটি ফ্ল্যাট।
উপশহর এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাক্তিরা বলেন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ১৪ ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর টুটুলের বালুর ট্রাকের ড্রাইভার ছিলো মনোয়ার হোসেন রাসেল ওরফে চিট রাসেল । এখন মাদক সম্রাট বলে খ্যাত। ইয়াবা ব্যবসার সুবাদে কোটিপতিও হয়েছে এই রাসেল। রাসেল এই সাবেক ১৪ ওয়ার্ড কাউন্সিলর টুটুল অন্যতম সহযোগী ছিলো। রাসেলের টাকার বদৌলতে টুটুল নিজের জন্যও করেছেন নামে–বেনামে অনেক সম্পদ। সেই সাথে রাসেলকে শেল্টার দিয়েছেন নিজের এলাকায় কিনে দিয়েছেন বাড়ি । আর ভিআইপি আদান-প্রদানের জন্য রাজশাহী শহরের অন্যতম আবাসিক এলাকা উপশহরে কিনিয়ে দিয়েছেন অভিজাত ফ্লাট । আর এই ফ্ল্যাটের অন্তড়ালে চলে ইয়াবা ব্যাবসার আদান-প্রদান।
শুধু তাই নয় রাসেলের ব্যাবহৃত স্কুটি বাইকটি তিনি তার ব্যাক্তিগত প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে ব্যবহার করতেন বলে গত বছরে একটি অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়াও রাজশাহীতে পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ সরকার হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য মামলায় জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানো হয় বিএনপির মদদপুষ্ট ১৪ নং ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর টুটুলকে।
গোদাগাড়িবাসী জানান, এর আগে রাসেল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কক্সবাজারে চারবার আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ আটক হলেও প্রতিবারই কোটি টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেয়ে যায় । দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামে মাদকের মামলা হলেও বিপুল টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে নিজের নাম বাদ দিতে সক্ষম হয় তিনি।
গোদাগাড়ী এলাকাবাসী ও থানা সূত্রে জানা গেছে, মাদক সম্রাট মনোয়ার হোসেন রাসেল এলাকায় চিট রাসেল নামেই পরিচিত। বছর পাঁচেক আগে রাসেল টেম্পোর হেলপারি করত। পরে হয় বাসের হেলপার, পরে ড্রাইভার। তার বাবার নাম লুৎফর রহমান। বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা গ্রামে। আর্থিক দৈন্যতায় পড়ে রাসেল কয়েক বছর আগে গোদাগাড়ীর কয়েকটি মাদক সিন্ডিকেটের কামলা হিসেবে কাজ করত। টাকার বিনিময়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিত তাদের হেরোইন। গোদাগাড়ী থেকে ঢাকায় হেরোইন পৌঁছানোর কাজ করতে করতে রাসেল একসময় নিজেই নেমে পড়ে মাদক ব্যবসায়।
পুলিশ আরও জানায়, প্রথমে হেরোইনের ছোট ছোট চালান নিয়ে ঢাকায় বিক্রি করত রাসেল। এই ব্যবসার মাধ্যমে কক্সবাজারের একটি ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে। এরপর নিজেই কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে মোটরসাইকেলে রাজশাহী আসতে শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যেই রাসেল বিপুল টাকার মালিক হয়ে যায়। ইয়াবা ব্যবসার প্রসারে নিজেই কিনে ফেলে চারটি ট্রাক ও দুটি পিকআপ। এসব ট্রাক ও পিকআপে করে সরাসরি টেকনাফ থেকে রাজশাহীতে ইয়াবা চালান করছিল সে।
সম্প্রতি আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে ইয়াবার চালান পৌঁছানো কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু রাসেল তার মাদক বাণিজ্য পুলিশের বিভিন্ন স্তর ম্যানেজ করে রমরমাভাবেই চালাচ্ছিল বলে জানা যায়। এছাড়া রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে ইয়াবা সরবরাহকারী বড় কয়েকটি সিন্ডিকেট আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় মাদক ব্যবসা থেকে সরে গেছে। রাসেল এ সুবাদে তার নেটওয়ার্ক খুব অল্প সময়ে সম্প্রসারণ করেছিলো গোটা অঞ্চলে।