আভা ডেস্কঃ অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে আবাসন প্রকল্পের নামে প্রবাসীর জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে খোদ পুলিশপ্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সাহাব উদ্দিন মোল্লা।
তবে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সেনা কর্মকর্তার অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। মূল্যবান জমি নিয়ে উভয় পক্ষে প্রভাবশালীদের তদবিরের চাপে স্থানীয় পুলিশ অনেকটা অসহায়। যদিও এখন পর্যন্ত পুলিশি তদন্তে অভিযোগকারীর বক্তব্য সত্য বলে প্রতীয়মান। কিন্তু কার্যত পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।
প্রসঙ্গত, সাভার থানা শহর সংলগ্ন বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই আবাসিক পল্লীর নাম ‘জাহাঙ্গীনগর কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি’। এর নেতৃত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এবং বর্তমান কয়েকজন শিক্ষক। বর্তমানে হাউজিংয়ে জমির পরিমাণ অন্তত ৫০ একর।
হাউজিংয়ের অভ্যন্তরে ৩৯ শতাংশ জমির মালিকানা দাবি করছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সাহাব উদ্দিন মোল্লা ও তাদের ভাই-বোন। তাদের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরনগর হাউজিং সোসাইটি তাদের পৈতৃক জমি দখল করেছে। মূল্যবান এই জমির বর্তমান বাজার দর অন্তত ৫ কোটি টাকা।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাউজিং সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সাভার থানায় জিডি করেন সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সাহাব উদ্দিন মোল্লা। এতে বলা হয়, ভাটপাড়া মৌজায় আরএস ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ১৯, ২০, ২১, ২৪, ২৫৯ ও ২৬০ নম্বর দাগের জমিগুলো তাদের পৈতৃক সম্পত্তি।
উত্তরাধিকার সূত্রে তারা ৫ ভাই ও ৩ বোন এখন এর মালিক। সম্পত্তির চারপাশ প্রাচীরঘেরা অবস্থায় তারা নির্বিঘ্নে ভোগ-দখল করে আসছিলেন। কিন্তু হাউজিং সোসাইটির নেতা ইলিয়াস মোল্লা ও মনজরুল করিম জমিটি দখল করে নেন।
স্থানীয়রা এর প্রতিবাদ করলে ভূমিদস্যুরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। জমির চারপাশে ধারালো অস্ত্রের মহড়া শুরু করে তারা।
মেজর (অব.) সাহাব উদ্দিন মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলাম। কিন্তু রাতের আঁধারে হাউজিং সোসাইটির লোকজন সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেছে। এমনকি তারা আমার কেয়ারটেকারকেও আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখায়। অস্ত্রধারীদের মহড়ার কারণে আমরা এখন জমিতে যেতে পারছি না। অথচ ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি খাজনা পরিশোধ করেছি।’
জানা যায়, এ সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় পুলিশ। কারণ তদন্ত শুরু হতে না হতেই উভয় পক্ষ থেকেই পুলিশের কাছে প্রভাবশালী মহলের ফোন আসতে শুরু করে।
সাভার থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সাবেক ছাত্রদের মধ্যে যারা পুলিশের এবং প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, তাদের দিয়ে থানায় ফোন করান। আবার বাদীপক্ষ স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে থানার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে থানা পুলিশের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
জিডির তদন্ত কর্মকর্তা সাভার থানার এসআই মোফাজ্জেল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘থানায় জিডি হওয়ার পর ঘটনার বিষয়ে জানার জন্য আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু দু’পক্ষ থেকেই থানায় ব্যাপক তদবির শুরু হয়। ফলে তদন্ত বেশিদূর এগোয়নি। পরে ওসি স্যার উভয় পক্ষকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।’
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাহাব উদ্দিন মোল্লার ভাই-বোনদের প্রায় সবাই দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ফলে তাদের পক্ষে সার্বক্ষণিক দেশে থেকে জমি উদ্ধারের দৌড়ঝাঁপ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার থানা পুলিশের মাধ্যমেও বিষয়টি সুরাহা হয়নি।
বাধ্য হয়ে পুলিশ সদর দফতরে হাজির হন ভুক্তভোগীরা। তাদের প্রবাসীকল্যাণ সেল ও আইজিপি বরাবর অভিযোগ দিতে বলা হয়। এরপর যথাস্থানে জমা দেয়া তাদের দুটি আবেদনপত্রের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ সদর দফতর থেকে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
জমির অন্যতম ওয়ারিশ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মনিরুল হক মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা যেহেতু বিদেশে থাকি। তাই হাউজিং সোসাইটি মনে করে, এই জমি আমরা কোনোভাবেই উদ্ধার করতে পারব না। এ কারণে তারা টালবাহানার পথ বেছে নিয়েছে। এ নিয়ে একাধিকবার মীমাংসা বৈঠক হয়েছে। তারা দখলকৃত জমি নিজেদের বলে দাবি করে। কিন্তু মালিকানার পক্ষে কোনো কাগজপত্র হাজির করতে পারে না। ফলে প্রতিবারই সমঝোতা ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। ২০১১ সালে এক মিটিংয়ের পর হাউজিং সোসাইটি আমাদের ৫ লাখ টাকায় মীমাংসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি। কারণ বর্তমানে এই জমির বাজারমূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকা।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য একেবারে পরিষ্কার- হাউজিং কর্তৃপক্ষ যদি জমির মালিকানার স্বপক্ষে ন্যূনতম দালিলিক প্রমাণ হাজির করে তবে আমরা বিনাবাক্যে মালিকানা সংক্রান্ত সব দাবি ছেড়ে দেব। আর কোনোদিন এ সংক্রান্ত দাবি নিয়ে হাজির হব না। কিন্তু আমরা জানি, হাউজিং কর্তৃপক্ষ তা কোনোদিনই পারবে না।’
২৫ ডিসেম্বর সরেজমিনে হাউজিং সোসাইটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই আবাসিক এলাকা। সভারের ভাটপাড়া ও রাঢ়িবাড়ি মৌজায় পড়েছে এলাকাটি।
ইতিমধ্যে সোসাইটির ভেতরে প্রচুর ছোট-বড় আবাসিক ভবন নির্মিত হয়েছে। হাউজিংয়ের ভেতরে একটি বড় খাল বয়ে গেছে। খালের দুই পাশ ভরাট করে ফেলায় খালের পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে এখন মৃতপ্রায়। ধীরে ধীরে খাল পুরোটাই বিলীন হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিবদমান জমিটির অবস্থান হাউজিংয়ের ‘বি’ ব্লকে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, শুরু থেকেই হাউজিং সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ইলিয়াস মোল্লা। তিনিই মূলত হাউজিং সোসাইটির মূল নিয়ন্ত্রণকারী। তার কথার বাইরে হাউজিংয়ে কিছুই হয় না।
বর্তমানে হাউজিং সোসাইটি পরিচালনার জন্য ১২ জনের একটি কমিটি রয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন, ফজলুর রহমান, অধ্যাপক ড. মনজরুল করিম, ফজলুল হক, অধ্যাপক ড. নুরুন নাহার, অধ্যাপক ড. আলী আহমেদ হাওলাদার, ইমরুল হাসান ভূঁইয়া, অধ্যাপক অসিত বরণ পাল, অধ্যাপক ড. শফি মোহাম্মদ তারেক, অমিতাভ সরকার, শাহনেওয়াজ কবির শুভ্র ও শফিকুর রহমান মোল্লা।
তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন কমিটির সভাপতি ও মনজরুল করিম সাধারণ সম্পাদক। বাকি সবাই পরিচালক।
জাহাঙ্গীনগর কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মনজরুল করিম মুঠোফোনে যুগান্তরকে জানান, ‘কারও জমি দখল করা হয়নি। হাউজিংয়ের অভ্যন্তরে থাকা সব জমির বৈধ কাগজপত্র তাদের কাছে রয়েছে।’
সাভার থানার পরিদর্শক তদন্ত সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘উভয় পক্ষই জমির মালিকানা দাবি করে আসছে। ফলে সমঝোতার উদ্যোগ সফল হয়নি। তবে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে পুলিশের কিছুই করার নেই। বিষয়টি আদালতের মাধ্যমেই ফয়সালা হতে হবে।’
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন মাসুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিবদমান জমি নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা একাধিকবার মীমাংসা বৈঠকে বসেন। কিন্তু হাউজিং সোসাইটির একগুঁয়েমি আর উদ্ধত আচরণের কারণে তা সফল হয়নি।
যুগান্তর