আভা ডেস্কঃ রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বর্ষাকে (১৪) ধর্ষণ এবং ক্ষোভে অভিমানে আত্মহত্যার ঘটনায় ওসি আবুল হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বারখাস্তের পর তাঁকে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। গত সোমবার বিকেলে ওসিকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে ক্লোজড করা হয়। এরপর গত মঙ্গলবার তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা করা হয়। এরপর বেরিয়ে আসছে তার নানা অপকর্মের তথ্য।
এর আগে স্কুল ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বর্ষার আত্মহত্যার পেছনে পুলিশের গাফলতির বিষয়টি নিয়ে গত ১৯ মে একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ হয়। এরপর পুলিশ মামলাটি সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে ওসি আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করে নেয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্কুল ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বর্ষাকে নিয়ে প্রথমে একটি অপহরণ মামলা হয়। এরপর গত ১৬ মে মেয়েটি আত্মহত্যা করার পর আত্মহত্যা প্ররোচণার অভিযোগের আরেকটি মামলা হয়। এই মামলা দুটি সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে ওসি আবুল হোসেনকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। পরে তার বিরুদ্ধে গাফলতির অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এদিকে সিল্কসিটিনিউজে ও কালের কণ্ঠে খবর প্রকাশের পর গত ১৯ মে ওসি আবুল হোসেন মেয়েটির বাবা ও মামলার বাদী আব্দুল মান্নানের বাড়িতে গিয়ে পুলিশের গাফলতি নিয়ে আর কোনো সাংবাদিকেকে কিছু না জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। পাশাপাশি তিনি আব্দুল মান্নানকে ১০ হাজার টাকা অনুদানসহ বাড়িতে পানি পানের জন্য একটি মোটর বসানো এবং বাড়ি সংস্কারের প্রস্তাব দেন। এই ধরনের একটি অডিও রেকর্ডও হাতে এসে পৌঁছেছে।
বাদী আব্দুল মান্নানও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশের গাফলতির সংবাদ প্রকাশের পর ওইদিনই ওসি আমার বাড়িতে এসে আমাকে নানাভাবে প্রলোভন দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি বিষয়টি কাউকে আর না বলার জন্য অনুরোধ করেছেন।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওসি আবুল হোসেন মোহনপুরে থাকাকালীন টাকার টাকার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তিনি করেননি। এ কারণে বর্ষাকে ধর্ষণের পর রাস্তার ধারে ফেলে রেখে চলে গেলেও ওসি ধর্ষণ মামলা না নিয়ে অপহরণ মামলা গ্রহণ করেন পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে। গত ২৩ এপ্রিল ঘটনার দিনই পুলিশ তিনজনকে আটক করলেও টাকার বিনিময়ে ওসি তিনজনকেই ছেড়ে দেন। বিনিময়ে মুল আসামি মুকুলের নিকট থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং তার সহযোগী শিবপুর এলাকার নাইমুল ইসলামের বাবার নিকট থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করেন ওসি। নাইমের বাবা ধনি শ্রেণির হওয়ায় তার নিকট থেকে বেশি টাকা আদায় করা হয়। পরে ২৭ এপ্রিল অপহরণ মামলা হওয়ার পরে মুকুল এবং সোনিয়া নামের এক স্কুল ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তারের পরেও ওসি আসামিদের নিকট থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে উল্টো ভিকটিম এবং ভিকটিমের পরিবারকেই নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন। এমনকি ওসি মামলার বাদী ও মেয়েটির বাবা আব্দুল মান্নানকেও পিটিয়ে দাঁত ভেঙে দিতে চান। এতেই ক্ষোভে অভিমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সুমাইয়া আক্তার বর্ষা। আত্মহত্যার পরে ওসি নিজেকে আড়াল করতে মুকুলের ৭০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধা নারীসহ অপর দুই আত্মীয়কে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, মাদকসহ ধরে এনেও ওসি আসামি ছেড়ে দিয়ে বিপুল অংকের টাকার বাণিজ্য করতেন। আবার মাদকসহ ধরে টাকার বিনিময়ে কখনো কখনো মাদক সেবন করে মাতলামির অভিযোগে মামলা দিয়ে আসামিদের আদালতে প্রেরণ করা হত।
মোহনপুর থানার ওসি তদন্ত আফজাল হোসেনসহ দুই-একজন এসআইও ওসির এই অপকর্মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন। যাদের কারণে অতিষ্ঠ মোহনপুরের সাধারণ মানুষ। এই এসআইরা সাধারণ মানুষকেও ধরে এনে ওসির সঙ্গে দেন-দরবার করে টাকা নিয়ে পরে ছেড়ে দেন। আবার তাদের চাহিদা পূরণ না হলেই বিভিন্ন মামলা দিয়ে পাঠানো হয় জেলহাজতে।
সম্প্রতি নওগাঁর মান্দার সাবাইহাটের চার যুবককে চোলাই মদসহ আটক করেও ওসির নেতৃত্বে প্রত্যেক জনের নিকট থেকে ৬০ হাজার করে টাকা নিয়ে তিনজনকে মাদক সেবনের অভিযোগে (৫৪ ধারায়) আদালতে পাঠানো হয়। আর একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে ওইদিনই তিনজন আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পান।
এছাড়াও কয়েকদিন আগে মোহনপুরের এক স্কুল শিক্ষককে ফেনসিডিলসহ আটক করেও ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন ওসি আবুল হোসেন।
এর বাইরে থানাসংলগ্ন একটি মার্কেট উচ্ছেদের পর পুনরায় ব্যবসায়ীদের দোকান বাসানোর নামে একেকজনের নিকট থেকে ৩০-৬০ হাজার টাকা করে আদায় করেন ওসি। যাদের নিকট থেকে টাকা আদায় করা হয়, তারা হলেন সুকুমার, হাবিবুর রহমান, রুবলে হোসেন, সাইদুর রহমান, জাহিদা বেগমসহ প্রমুখ।
এদের মধ্যে একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, টাকা না দিলে ওসি নতুন করে সেখানে দোকান বসাতে দিতেন না। এ কারণেই ৬০ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।’
প্রসঙ্গত, গত ২৩ এপ্রিল বাড়িতে কোচিং সেন্টারে পড়তে যাওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় স্কুল ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার বর্ষাকে। এরপর রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর মেয়েটির বাবা থানায় ধর্ষণের মামলা দিলেও পুলিশ সেটি গ্রহণ না করে অপহরণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা নেয় পুলিশ। আর সেই মামলায় দফায় দফায় তদন্তের নামে চলে মেয়েটির ওপর মানসিক নির্যাতন। পাশাপাশি প্রতিবেশীদের নানা ধরনের অশালিন মন্তব্য।
একপর্যায়ে গত ১৬ মে আত্মহত্যার পথ বেছে নেই সুদর্শনা কিশোরী মেয়েটি।
তবে এসব নিয়ে গতকাল মোহনপুর থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া ওসি আবুল হোসেনের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
সিল্কসিটি