আভা ডেস্ক : মানিকগঞ্জের সরকারি বালুমহাল যেন সোনার খনি। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে আওয়ামী লীগ নেতারা প্রথমে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। প্রতিটি এক লাখ টাকা মূল্যের ১০০টি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এক কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করেন। এই টাকা দিয়ে ইজারা ও অফিস খরচ মেটান।
রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে ৯টি বালুমহাল রয়েছে। নামে বালুমহাল হলেও এখানে মূলত রয়েছে ছোট দানার বালু মেশানো পলি মাটি। স্থানীয়ভাবে বলা হয় ভিটি মাটি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে উজানের পানির সঙ্গে পলি এসে নদীর বিভিন্ন স্থানে চরের সৃষ্টি করে। এ রকম ৯টি স্থানকে মহাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত জমি ভরাটের কাজে এই মাটি ব্যবহার হয়। এ ছাড়া মোটা দানার বালু পাওয়া যায় কোনো কোনো মহাল থেকে, যা ব্যবহার করা হয় পাকা স্থাপনা নির্মাণের কাজে। এসব বালুমহাল সরকার প্রতিবছর দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলা সনকে অনুসরণ করে বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত ইজারাকাল ধরা হয়।
মানিকগঞ্জ সদর, ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত কালীগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে মহালগুলোর অবস্থান। সদর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর পাঁচটি মহাল হচ্ছে, ১. আউটপাড়া-বিপ্রবেতিলা-সনসিঙ্গা-রতনপুর, ২. বেউথা-পৌলী, ৩. উত্তর পুটাইল-লেমুবাড়ী-হিজলাইন, ৪. খাগড়াকুড়ি-বিলবড়িয়াল ও ৫. চামটা। ঘিওর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর দুটি মহাল হচ্ছে ৬. তরা ‘ক’ ও ৭. তরা ‘খ’। সাটুরিয়া উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর দুটি মহাল হচ্ছে ৮. রাজৈর-ছনকা-বরাইদ-গোপালপুর-হাড়াইপাড়া, পাতিলাপাড়া ও ৯. তিল্লী- চরতিল্লী- আকাশী- পাচুটিয়া- আউটঘরিয়া।
এ বছর বালুমহালের প্রথম চারটির ইজারাদার হচ্ছেন মেসার্স সরকার অ্যান্ড সন্সের মালিক আফসার উদ্দিন সরকার। তিনি সদর উপজেলার গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। চারটি বালুমহালের জন্য তিনি ইজারা মূল্য দেন ৪৩ লাখ ৭১ হাজার ৩২০ টাকা। পরের তিনটি বালুমহালের ইজারাদার হচ্ছেন মেসার্স শামীম এন্টারপ্রাইজের মালিক শামীম মিয়া। তিনি মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা। তিনটি বালুমহালের ইজারা মূল্য দিয়েছেন ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৫০ টাকা। বাকি দুটি মহালের ইজারাদার হচ্ছেন মেসার্স সহায়কের মালিক সুভাষ চন্দ্র সরকার ও মেসার্স চারুতার মালিক এহতেশাম হোসেন। সুভাষ জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য ও মানিকগঞ্জ পৌরসভার কমিশনার। তিনি মানিকগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এহতেশাম জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। ৯টি মহালের মোট ইজারা মূল্য হচ্ছে ৭৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪২০ টাকা।
গত বছর প্রথম পাঁচটির আফসার। ৬ নম্বর মহালের ইজারাদার ছিলেন এহতেশাম। ৮ ও ৯ নম্বর মহালের ইজারাদার ছিলেন শামীম মিয়া। ৯টি মহালের মোট ইজারা মূল্য ছিল ৭২ লাখ ৩৬ হাজার ২১৮ টাকা।
সাবেক ইজারাদাররা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পেশাদার বালু ব্যবসায়ীরা ইজারা দরপত্রে অংশ নিতে পারছেন না। এটির পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। তাঁরা পাতানো দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা নেন।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, পৃথক নামে ইজারা নিলেও ৯টি বালুমহালকে নিয়ে গঠন করা হয় একটি সিন্ডিকেট। প্রতিটি এক লাখ টাকা মূল্যের ১০০টি শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে এক কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। এই টাকা দিয়ে ইজারা মূল্য পরিশোধ ও অফিস খরচ মেটানো হয়। তবে যে কেউ এই শেয়ার কিনতে পারেন না। তাঁকে অবশ্যই হতে হবে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের পদাধিকারী। পদের গুরুত্ব এবং সেই ব্যক্তির প্রভাব অনুযায়ী সর্বোচ্চ পাঁচটি শেয়ার দেওয়া হয়। তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী একজনের নামেই রয়েছে ৪০টি শেয়ার। আবার একটি শেয়ার দেওয়া হয়েছে দুই-তিনজনকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শেয়ারার জানান, এক লাখ টাকার একটি শেয়ার থেকে বছরে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা লাভ পাওয়া যায়। এ হিসাবে প্রতিবছর ১০০টি শেয়ার থেকে লাভ হয় কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকা।
স্থানীয়রা জানায়, বর্তমানে এক ট্রাক ভিটি মাটির দাম নেওয়া হচ্ছে মহালের অবস্থান ভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এক ট্রাকে সর্বোচ্চ মাটি ধরে ২০০ ঘনফুট। এ হিসাবে প্রতি ঘনফুট মাটির দাম নেওয়া হচ্ছে দেড় থেকে দুই টাকা। শুকনো মৌসুমে ট্রাক সরাসরি চরে নেমে যায়। আর বর্ষার সময় ড্রেজারের মাধ্যমে নদীর পারে বালু ডাম্পিং করা হয়। ফলে শুকনো মৌসুম ও বর্ষা মৌসুমে ভিটি মাটির দামের হেরফের হয়। এ ছাড়া মহালে ড্রেজার বসিয়ে পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ক্রেতার নির্ধারিত স্থানে ভিটি মাটি ফেলা হয়। এখানেও দামের তারতম্য হয়।
ইজারাদার এহতেশাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমার নামে একটি মহাল ইজারা নেওয়া হলেও কোনো শেয়ার নেই। মহাল দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন আরেক ইজারাদার আফসার উদ্দিন সরকার।’
আফসার উদ্দিন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মিলেমিশে ব্যবসা পরিচালনার কথা স্বীকার করলেও একে ‘সিন্ডিকেট’ বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার সুবিধার্থে প্রতিটি এক লাখ টাকা মূল্যের ১০০টি শেয়ার ছাড়া হয়েছে। শেয়ারগুলো আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মধ্যে বিক্রি করা হয়েছে। প্রতিটি শেয়ারের লভ্যাংশ পায় জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের তৃণমূল কর্মীরা।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘বালুমহাল ইজারা নিয়ে এমন ব্যবসা করে নেতাদের মুখে চুনকালি মাখা হচ্ছে।’