আভা ডেস্ক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীর অবস্থান প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হলেও তাদের ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
নূর চৌধুরী কানাডায়, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, শরিফুল হক ডালিম স্পেনে এবং মোসলেম উদ্দিন জার্মানিতে আছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। আর খুনি খন্দকার আবদুর রশীদ ও আবদুল মাজেদ কোথায় আছেন সেটা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে কেউ কেউ বলছেন, খন্দকার আবদুর রশীদ পাকিস্তানে এবং আবদুল মাজেদ ভারতে আছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যার রায় হয়েছে ৭ বছর আগে। কিন্তু এসব খুনিকে ফেরত এনে রায় কার্যকর করার বিষয়ে আইনি জটিলতার কথা স্বীকার করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শনিবার নিজ দফতরে এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, তাদের দেশে ফেরত আনা সহজ বিষয় নয়। আওয়ামী লীগ ছাড়া বিগত দিনের সরকার প্রধানরা এমনভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন যে, তারা যেখানে রয়েছেন পোক্তভাবে জেঁকে বসেছেন।
কারও নাম উল্লেখ না করে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা দু’জনের ব্যাপারে তথ্য জানি। তাদের আইনগতভাবে দেশে ফেরানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আলাপ-আলোচনা ও আইন প্রক্রিয়াও অব্যাহত রয়েছে।
নুর চৌধুরীর বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সে কানাডা সরকারকে বলেছে দেশে ফেরত পাঠানো হলে রায় অনুযায়ী ফাঁসি হবে। তার কোনো নাগরিকত্ব নেই। তাকে ফেরত আনার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। তবে কানাডার সঙ্গে বন্দিবিনিময় চূক্তি না থাকায় বিষয়টি সম্ভব হচ্ছে না। তবে থেমে নেই উদ্যোগ।
গত বছরের আগস্টে গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন- যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে মৃত্যুদণ্ড আছে। তাই রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাবে না, এরকম কোনো অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তাই রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়ে অনেক অগ্রগতি হয়েছে, আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। এর বেশি আর কিছু বলব না।
সূত্রমতে, কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীর ক্ষেত্রে দেশটির সরকার বারবার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের নীতিগত অবস্থানের কথা তুলে ধরছে। তবে নূর চৌধুরী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েও তা পাননি। এই আত্মস্বীকৃত খুনি সাধারণভাবে অবস্থানের অনুমতির মেয়াদ বাড়িয়ে কানাডায় বসবাস করছেন।
কানাডার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই সদস্য রাষ্ট্র জার্মানি ও স্পেনে এক সময় মৃত্যুদণ্ড থাকলেও এখন আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই এই দুই দেশও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ না থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনতে ২০১৫ সালের মে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে যুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। সংস্থাটি এ বিষয়ে মর্কিন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমদু আলী ২০১৬ সালে মার্কিন আইন দফতরে চিঠি পাঠান।
স্কাডেন এলএলপি গত বছর জানায়, রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরতে দিতে ইতিবাচক আলোচনা করেছে। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের অনুরোধে রাজনৈতিক আশ্রয় না পাওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি একেএম মহিউদ্দিনকে ২০০৭ সালে ফেরত দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে বিচার বন্ধ করা হয়। ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকার সংশ্লিষ্ট খুনিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে।
এরপর তারা বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তারা বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে তাদের দূতাবাসের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়। তবে খুনিরা দেশে ফিরে না এসে পালিয়ে যান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ২ অক্টোবর রাজধানীর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন।
নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার-প্রক্রিয়া।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। হাইকোর্টের দেয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর হয়। ওই রায় কার্যকরের আগেই ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা। পলাতক বাকি ছয়জন হলেন- খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এএম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও মোসলেম উদ্দিন।
jugantor