তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে বন, সে বনে নাম না জানা কত পশু

Ava Desk : তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে বন, সে বনে নাম না জানা কত পশু। কারোর চোখে জোনাকি জ্বলে, কারো মুখ দিয়ে আগুন বের হয়। বন পেরিয়ে পাহাড়, সে পাহাড়ে ওঠা খুব সহজ নয়, কত দেবতা, উপদেবতা আর রাক্ষসের বাস সেখানে। পাহাড় পেরিয়ে যে উপত্যকা সেখানে পরীরা গান গায়, তাদের জলকেলিতে মুখরিত হয় পুরো এলাকা। পরীরা গোসল করে যেখানে সেই ফোয়ারা অনন্ত যৌবনের ফোয়ারা। একবার তার পানি পান করলে, অথবা একটা ডুব দিতে পারলে বৃদ্ধ হবে টগবগে যুবক, অশীতিপর বৃদ্ধা হবে সুন্দরী তরুণী। এমনই সব কল্পনা করা হতো অনন্ত যৌবনের ফোয়ারাকে নিয়ে। প্রাচীনকালে আজন্ম শৈশব, কৈশোর, যৌবন নিয়ে নস্টালজিক বৃদ্ধরা বসে বসে এমন সব ফোয়ারার গল্প করতেন, কিছু মানুষ বিশ্বাসও করত তাদের কথা। কিন্তু একটা সময় গালগল্পের পাড়া ছেড়ে বিখ্যাত অভিযাত্রীদের কেউ কেউ দাবি করতে লাগলেন, তারা আবিষ্কার করেছেন যৌবনদায়ী ফোয়ারা। তাহলে কি আসলেই অস্তিত্ব আছে এমন কিছুর?\


মানুষের কল্পনায় যৌবনের ফোয়ারা; image source: PotC Wiki-Fandom

হেরোডোটাস, আলেকজান্ডার পর্যন্ত এমন পানির উৎসের কথা বলে গেছেন। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট নাকি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অব্দে তার এক দাসকে নিয়ে এমন এক স্থান পার করেছিলেন, যা ছিল গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। কিংবদন্তিতে বলা হয়, সেখানে তিনি স্বর্গের নদীর সন্ধান পান। সেই নদীর পানি সকল রোগ নিরাময় করে, আর দীর্ঘজীবী করে নশ্বর মানুষকে। স্থানের হিসাবে বর্তমানের জাপানের কিছু দ্বীপে, পলিনেশিয়া, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কিছু দুর্গম অঞ্চলে এমন ফোয়ারা থাকার কথা বেশি উচ্চারিত হতো। কিছু ইউরোপীয় প্রিস্টার জন নামক রাজার অলৌকিক রাজত্বে পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন। তাদের বিশ্বাস মোতাবেক, এই রাজার রাজত্বে হাতিশালে হাতি আর ঘোড়াশালে ঘোড়ার পাশাপাশি ছিল অলৌকিক ফোয়ারা, আর স্বর্ণনদী।

ক্যারিবীয় কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাঝে ফোয়ারার গল্প প্রচলিত ছিল। জুয়ান পন্স ডি লিওন ছিলেন পুয়ের্তো রিকোর প্রথম গভর্নর। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ দমন করে শত শত একর জমির মালিক হয়েছিলেন। আদিবাসীদের জমিতেই তাদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে ফসল আর গবাদি পশুপালন চলতো। ১৫০৮ সালে রাজকীয় অনুমতিতে বর্তমান পুয়ের্তো রিকোতে গভর্নর হয়ে বসেন। আমেরিকার আদিবাসীরা তাকে বলেছিল, এমন ফোয়ারা আছে বিমিনিতে বা কিউবার উত্তরে। ১৫১৩ সালে বর্তমানকালের ফ্লোরিডা ভ্রমণের সময় তিনি নাকি যৌবনের ফোয়ারা খুঁজছিলেন। পন্স ডি লিওনের কারণে এই ফোয়ারার গল্প নতুন করে জনসম্মুখে আসে।

জুয়ান পন্স ডি লিওন; image source: britannica.com

পন্স ডি লিওনের ফোয়ারার অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানা মত আছে। কেউ মনে করেন রাজা ফার্দিনান্দের প্রিয়পাত্র পন্স ১৫১২ সালে বিমিনি দ্বীপ অভিযান সংক্রান্ত একটা চুক্তি করেন রাজার সাথে। এই ধারার ঐতিহাসিকদের ধারণা অলৌকিক পানির ফোয়ারার ব্যাপারটা পন্স ডি লিওন নিজের মনেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। গভর্নরের কাজের উন্নতির জন্য আরো একটা নতুন দ্বীপে শাসন স্থাপনের উদ্দেশ্য দেখিয়ে ফার্দিনান্দকে রাজি করিয়েছিলেন।

অপরদিকে ঐতিহাসিকদের আরেক ধারা ভাবে, পন্স ডি লিওন ফোয়ারা খুঁজে বেড়াবার মতো বোকা নয়, বরং বিষয়জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন আর তিনি ভালোমতোই জানতেন যে এমন কিছু খুঁজে পাবেন না। তিনি নিজের কাজেই বিমিনি যাচ্ছিলেন, ফার্দিনান্দই এরকম ফোয়ারার বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তখন ফার্দিনান্দ বিয়ে করেছেন নিজের থেকে ৩৫ বছরের ছোট এক তরুণীকে। তাই তার অনন্ত যৌবনের ফোয়ারার বিষয়ে আগ্রহ দেখানোটাও তখন স্বাভাবিক। ফার্দিনান্দের সাথে পন্স ডি লিওনের যে যোগাযোগ হতো, বা তার নিজের ভ্রমণকথার কোথাও তিনি অলৌকিক ফোয়ারা খুঁজছেন এমনটার উল্লেখ নেই। আট বছর পর পন্স ফিরে এসেছিলেন ফ্লোরিডার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে, খুব সম্ভবত উপনিবেশ স্থাপন করতেই। কিন্তু এক আদিবাসীর তীরে তাকে শয্যাশায়ী হতে হয়। সে স্থান ত্যাগ করার আগে রাজা পঞ্চম চার্লস আর পোপ ষষ্ঠ আদ্রিয়ানকে চিঠি লিখেছিলেন। আর প্রত্যেকবারের মতো এবারও তার উদ্ভট অনুসন্ধানের কোনো নামগন্ধ ছিল না চিঠিতে। বরং কীভাবে উপনিবেশ বাড়ানো যায়, খ্রিস্টধর্মের প্রসার করা যায়, সেসব লিখেছিলেন তাতে।


আদিবাসীদের সাথে যুদ্ধে আহত হন পন্স; image source: 8th grade US history

পন্স ডি লিওনের মৃত্যুর পরই তার অভিযানের গল্প চাউর হয়। ১৫৩৫ সালে গঞ্জালো ফার্নান্দেজ ডি ওভিডো দাবি করেন, পন্স সন্তান জন্মদানে অক্ষম, বৃদ্ধ ও দুর্বল ছিলেন। তাই আদিবাসী দাসদের কথা শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বিমিনি অভিযানে। কিন্তু এই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করে পন্সের বেশ কয়েক সন্তানের পিতৃত্ব এবং প্রথম অভিযানে যাবার সময় তার বয়স অনূর্ধ্ব চল্লিশের ঘরে থাকা।

হার্নান্দো নামের এক লোক জাহাজডুবি থেকে বেঁচে গিয়ে পরে ফ্লোরিডার ওই অঞ্চলের আদিবাসীদের সাথে বাস করেছিল বহু বছর। ১৫৭৫ সালে নিজের স্মৃতিকথায় সে পন্স ডি লিওনের অভিযানের উল্লেখ করে। স্পেনের রাজার প্রধান ঐতিহাসিক ১৬০১ সালে পন্স ডি লিওনের প্রথম অভিযানের বিস্তারিত বর্ণনা লিখে ফেলেন। সেখানে তিনি আরো অনেক কল্পকাহিনীর সাথে মিশিয়ে দেন ‘অশীতিপর বৃদ্ধের বালক হয়ে ওঠার ফোয়ারা’ খুঁজে পাবার কথা। তার ইতিহাসের বইতে সত্যিকারের ইতিহাস লেখার চেষ্টার চেয়ে বেশি দেখা যায় পাঠককে রূপকথা শুনিয়ে খুশি করার প্রচেষ্টা।

১৮১৯ সাল পর্যন্ত ফ্লোরিডায় পন্স ডি লিওনের কোনো আবিষ্কার নিয়ে আমেরিকা মাতামাতি করেনি। কিন্তু তারপর সাহিত্যিক আর চিত্রকারদের মাঝে পন্স ডি লিওনের অভিযানের বেশ প্রভাব দেখা যায়। ওয়াশিংটন আরভিং পর্যন্ত তার লেখায় পন্সকে অসুখী মানুষ হিসেবে দেখান। টমাস মোরান আঁকেন আদিবাসীদের সাথে পন্সের সাক্ষাতের ছবি। শিল্পসাহিত্য ছাড়াও ফোয়ারার গল্প আবেদন বাড়ায় ফ্লোরিডার। ফ্লোরিডার সবচেয়ে পুরোনো শহর সেইন্ট অগাস্টিনের এক স্থানকে দাবি করে বসা হয় পন্সের আবিষ্কৃত ফোয়ারা বলে। প্রতিবছর এই ফোয়ারা তথা কূপের ধারে ভিড় বাড়াতে থাকা পর্যটকেরা এর পানি বোতলে করে চড়া দামে কিনে পান করে। তাদের মতে, স্বর্গীয় বা জাদু সম্পর্কিত কোনো পানির উৎসের নাম মাথায় আসলে আমরা কল্পনা করি সুমিষ্ট সুপেয় কোনো পানি, অথচ সেইন্ট অগাস্টিনের কুয়ার পানিতে সালফারের কটু গন্ধ। ২০১৩ সালে ফোয়ারা তত্ত্ব, আর জুয়ান পন্স ডি লিওনের ভক্তেরা তার অভিযানের পাঁচশ বছর পূর্তিতে সাড়ম্বরে উৎসব পালন করে। ফ্লোরিডার সমুদ্র সৈকতের একটা নির্দিষ্ট স্থানকে পন্সের জাহাজের নোঙর ফেলার জায়গা ধরে তাদের উৎসব চলে।


কূপটি এখন ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে পরিচিত; image source: My American Odyssey

কিন্তু এতসব আয়োজনের পেছনে ইতিহাসটার ভিত্তি বেশ ফাঁপা। পন্স ডি লিওনের কোনো নথিপত্রে তার ফোয়ারা খুঁজে বেড়ানোর কথা পাওয়া যায়নি, এবং একজন অভিযাত্রী সব লিখলেও কেন একটা অন্যরকম আবিষ্কারের কথা লিখে রেখে যাবেন না, সেই সন্দেহের ব্যাখ্যা আগেও করা হয়েছে। এছাড়া ফোয়ারা নিয়ে আরো কিছু সাধারণ সত্য ফোয়ারার অস্তিত্ব নাকচ করে। প্রথমত, প্রতি বছর হাজারো বৃদ্ধ ফোয়ারার পানি খেয়ে নিজেদের বয়স একদিনও কমাতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, সেইন্ট অগাস্টিনের কূপটা পন্সের আবিষ্কার হতে পারে না, কারণ পন্স সেইন্ট অগাস্টিনের দিকে পা রাখেননি। তিনি গিয়েছিলেন বর্তমান দিনের মেলবোর্নের দিকে।

ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক রায়ান কে. স্মিথ বলেন, “একটা কিছু কোথাও আছে, এর থেকে কেউ একজন সেই বস্তুকে খুঁজে পেতে অভিযান চালিয়েছে, অতঃপর খুঁজে পেয়েছে এমন গল্প স্বভাবতই মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে।”তাই অভিযানের গল্পে রঙ চড়িয়ে কখনো অভিযাত্রীরা, কখনো তাদের পরের মানুষেরা উপাদেয় গল্প তৈরি করে গেছেন। মার্ক টোয়েন পর্যন্ত বলেছেন, “জীবন কতই না আনন্দের হতো, যদি আমরা ৮০ বছর বয়সে জন্মে ক্রমে ১৮ বছর বয়সে পৌঁছাতাম!”তাহলে মানুষ কেন চাইবে না এমন কিছু, যা তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তারুণ্যে? পৃথিবীতে এমন পানির উৎস থাকতে পারে, যারা উপস্থিত খনিজ উপাদানের কারণে বিশেষ কোনো রোগ থেকে মানুষকে আরোগ্য করতে সক্ষম। কিন্তু বয়স? সে শুধুই একটা সংখ্যা। তাকে পিছিয়ে নিতে পারে, এমন কোনো ফোয়ারা পৃথিবীতে থাকা কি আদৌ সম্ভব?

ফিচার ইমেজ সূত্র- my904news.com

Next Post

সু-চিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে রাজশাহী জেলা বিএনপি

শনি সেপ্টে. ৮ , ২০১৮
নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সু-চিকিৎসা ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে রাজশাহী জেলা বিএনপি। আজ শনিবার সকালে নগরীর সাহেববাজার সংলগ্ন মুনলাইট গার্ডেনে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহী জেলা বিএনপির সভাপতি এড.তোফাজ্জল হোসেন তপুর সভাপতিত্বে এ সময় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এড.কামরুল মনির। এ সময় […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links