চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না, ঘুষ যেন ওপেন সিক্রেট।

আভা ডেস্কঃ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না, নড়ে না কোনো ফাইল- এমন অভিযোগ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে এসি-ডিসি পর্যন্ত ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়টি অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’।

কোনো পণ্যের চালান খালাসের জন্য একজন এসি বা ডিসিকে পর্দার আড়ালে কত টাকা দিতে হয়, তা-ও সবার মুখে মুখে। শুধু তা-ই নয়, কোন কর্মকর্তা ‘ঘুষখোর’, কোন কর্মকর্তা কীভাবে কোন ফাঁদে ফেলে আমদানিকারক বা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে ঘুষ নেন- সেটিও কারও কাছে অজানা নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব যায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে। চলতি বছর এই রাজস্বের টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এখানে ১৩টি গ্রুপ রয়েছে। কোন পণ্য কোন গ্রুপে শুল্কায়ন হবে, তা নির্ধারিত। প্রত্যেকটি গ্রুপে কমবেশি ঘুষের লেনদেন হয়। গ্রুপের পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও), রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) সবাই ‘ঘুষ’ নেন। বিশেষ করে পণ্য শনাক্তকরণ এইচএস (হরমোনাইজিং সিস্টেম) কোডের ফাঁদে ফেলে ঘুষ আদায় করা হয়। ঘুষ আদায় করা হয় পণ্যের ল্যাব টেস্ট, কায়িক পরীক্ষা, শতভাগ পরীক্ষাসহ নানা অজুহাতে। এছাড়া প্রতিটি ফাইল উপস্থাপনের পর যতক্ষণ ফাইল চলবে, ততক্ষণ ঘাঁটে ঘাঁটে নির্ধারিত হারে ঘুষ দিতে হবে। ঘুষ বন্ধ তো ফাইল চলাচল বন্ধ। এই অনিয়মটাই যেন এখানে নিয়ম। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ৬ থেকে ৭টি ধাপে ঘুষ দিতে হয় বলে আমদানিকারকদের অভিযোগ।

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মহাবুবুল আলম কাস্টমসে অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানি প্রসঙ্গে শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন সরাসরি রাজস্বের জোগানদাতা। তাদের অযথা হয়রানি করা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। অথচ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে নানা অজুহাতে হয়রানির অভিযোগ নিত্যদিনের। হয়রানি ও অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস গড়তে তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সরকারের সর্বোচ্চ মহলের প্রতি দাবি জানান।

চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআই’র জেনারেল বডির মেম্বার মাহফুজুল হক শাহ যুগান্তরকে বলেন, কাস্টমসে অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির মূলে রয়েছে শুল্কায়ন পদ্ধতি পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন না হওয়া এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারা। বন্দরের প্রতিটি গেটে যেখানে একটি করে স্ক্যানার মেশিন প্রয়োজন, সেখানে আছে মাত্র চারটি। তা-ও আবার সবক’টি সবসময় সচল থাকে না। যে কারণে বন্দর থেকে পণ্য ডেলিভারি বাধাগ্রস্ত হয়। এসব কারণে পদে পদে আমদানি-রফতানিকারকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও দুর্নীতির সুযোগ পান। বিদ্যমান সংকট নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তথা সরকারকে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে চেম্বারসহ ব্যবসায়ী নেতারা বিভিন্ন সময়ে যেসব সুপারিশ করেছেন, সেসব সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই জাতীয় অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি, তা ধরে রাখা সম্ভব হবে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘যখন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ আদায় করেন বা দাবি করেন, তখন কেউ কিছু বলেন না। অভিযোগ নিয়ে আসেন না। কোনো পণ্য চালান আটকে গেলে বা সমস্যা হলে তখনই এ ধরনের অভিযোগগুলো করা হয়। এক্ষেত্রে আমদানিকারক বা সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদেরও নিশ্চয়ই দুর্বলতা থাকে। না হলে তারা কেন পণ্য চালান খালাসে ঘুষ দেবেন। আবার আটকে গেলে অভিযোগ করবেন। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ দিলে এবং তা প্রমাণ হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইন সবার জন্য সমান।’

আমদানিকারকরা জানান, পণ্য নিয়ে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ভেড়ার পর শিপিং এজেন্ট থেকে আমদানি চালানের আইজিএম (ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানুফেস্ট) নেয়ার পর ডকুমেন্ট উপস্থাপন করতে হয় কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট গ্রুপে। এখান থেকেই শুরু হয় ঘুষের লেনদেন। ডকুমেন্টে কোনো ঝামেলা নেই বা ‘ফ্রেশ ডকুমেন্ট’র ক্ষেত্রে প্রতি চালানের বিপরীতে ন্যূনতম ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।

সূত্র জানায়, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ১ হাজার টাকা, রাজস্ব কর্মকর্তা ১ হাজার টাকা, ফালতু (আন অফিসিয়াল কর্মচারী) ২০০ টাকা, ব্যাংকে ডিউটি বা শুল্ক জমা দেয়ার সময় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, ডকুমেন্ট আউট পাস বা ক্লিয়ারেন্সের সময় দিতে হয় ৫০০ টাকা। ঘুষ দিলে দিনে দিনে পণ্য চালানের অ্যাসেসমেন্ট বা শুল্কায়ন হয়। না দিলে ফাইল পড়ে থাকে। এছাড়া ডকুমেন্টে কোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি বা এইচএস কোড নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে তা আটকে যায় সহকারী কমিশনার বা এসির কাছে। এখান থেকেই শুরু হয় কর্তাদের ঘুষ আদায়ের খেলা। এসি বিরূপ মন্তব্য লিখে দিলে ফাইল যায় আরও ওপরে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এইচএস কোডের সামান্য টেকনিক্যাল ভুল কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলের বিষয়গুলোও সহজভাবে না দেখে চালান খালাস প্রক্রিয়া জটিল করে দেয়া হয় এই বিরূপ মন্তব্য লিখে। আবার দেখা যায়, তাদের সঙ্গে চালান ছাড়ে ‘ঘুষ’ প্রদানের চুক্তি হলে সেক্ষেত্রে সব ভুল মাফ হয়ে যায়। সব জটিলতা দূর হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিটি চালান শুল্কায়নে উৎকোচ আদায় করতেই ইচ্ছাকৃতভাবে সমস্যা ও জটিলতা সৃষ্টি করা হয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এসব সমস্যা করেন মূলত এসি (অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার) ও ডিসিরা (ডেপুটি কমিশনার)।

আরও জানা গেছে, কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সরাসরি আবার কেউ প্রতিনিধির মাধ্যমে পণ্যের চালান খালাসে নির্ধারিত অঙ্কের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হন। ঘুষের দেখা না পেলে এ ধরনের চালান খালাস প্রক্রিয়া নানা কৌশলে দীর্ঘায়িত করে দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে কখনও ল্যাব টেস্টের কথা লিখে দেয়া হয়, কখনও শতভাগ কায়িক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয় অথবা এইচএস কোডের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে চালান আটকে দেয়া হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কম শুল্কের পণ্য বাড়তি শুল্ক দিয়ে ছাড় করতে হয়। এক্ষেত্রে পোর্ট ও শিপিং লাইনের ডেমারেজ দিয়ে চড়া মাশুল গুনতে হয় আমদানিকরারকদের।

আমদানিকারক ও তাদের প্রতিনিধিদের অভিযোগ, গ্রুপ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে কর্মকর্তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। কাস্টম সরকার বা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যবহার করেন চাকর-বাকরের মতো। কাজ হোক বা না হোক, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভালো ব্যবহারটিও পান না তারা। অথচ রাজস্বে হাজার হাজার কোটি টাকার জোগান দেয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তারাও জড়িত।

সুত্রঃ যুগান্তর

Next Post

"মা" তোমার তুলনা শুধুই তুমি। আজ মা দিবস, সকল মায়ের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

রবি মে ১২ , ২০১৯
‘মধুর আমার মায়ের হাসি/চাঁদের মুখে ঝরে/মাকে মনে পড়ে আমার/মাকে মনে পড়ে।’ পৃথিবীতে ‘মা’ শব্দের চেয়ে অতি আপন শব্দ আর দ্বিতীয়টি নেই। সন্তানের কাছে সবচেয়ে আপন ও প্রিয় হচ্ছেন তার মা। মায়ের গর্ভে সন্তান যেমন রক্ত শুষে নিরাপদে ধীরে ধীরে বড় হয়, তেমনি জন্মের পরও তিল তিল করে মা-ই শুধু তার […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links