গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার চার্জশিট।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা ঘটনার দুই বছর হতে চলেছে। এরই মধ্যে এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট প্রস্তুত করেছে তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। তদন্তে আলোচিত এই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২১ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে সিটিটিসি। এদের মধ্যে ঘটনার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ হামলাকারী ছাড়াও আরও আট জন মারা গেছে সিটিটিসি ও র‌্যাবের অন্যান্য অপারেশনে। গ্রেফতার হওয়া ছয় আসামি ইতোমধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। দুই জনকে পলাতক দেখিয়ে চার্জশিট প্রস্তুত করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা।

বৃহস্পতিবার (২৮ জুন) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ‘কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত করেছেন। তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে আছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বা ১০ দিনের মধ্যে এই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করতে পারবো।’

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ৯ ইতালিয়ান, সাত জাপানিজ, একজন ভারতীয়, একজন আমেরিকান-বাংলাদেশ দ্বৈত নাগরিক ও দুজন বাংলাদেশি এবং দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিরা রেস্টেুরেন্টের অন্যান্য অতিথি এবং কর্মচারীদের রাতভর জিম্মি করে রাখে। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে শেষ হয় এই জিম্মিদশা। অপারেশন থান্ডারবোল্ট নামে পরিচালিত এই অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও একজন পিৎজা শেফ নিহত হয়। এছাড়া, ঘটনার সময় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হওয়া একজন কর্মচারী নিহত হন ৮ জুলাই। আলোচিত এই ঘটনায় গুলশান থানার পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করে।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আলোচিত এই ঘটনায় হামলার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ২১ জন জঙ্গির জড়িত থাকার তথ্য ও প্রমাণ তারা পেয়েছেন। তাদের নামেই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে যারা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার বিবরণ উল্লেখ করে চার্জশিটে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

জড়িত ২১ জন কারা?
সিটিটিসি সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জড়িত ২১ জঙ্গির সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং হত্যাকাণ্ডে তাদের কার কী ভূমিকা ছিল, তা তুলে ধরা হলো—
নিহত জঙ্গিরা (ওপরে বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটার মতো) তামিম, মারজান, জাহিদ, সারোয়ার, বাশার ও কাদেরিতামিম চৌধুরী: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীকে গুলশান হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে চার্জশিটে। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তুরস্ক হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তামিম। এরপর প্রথম দিকে জুনুদ আল তাওহিদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করার চেষ্টা করে সে। পরবর্তীতে পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা আব্দুস সামাদ মামু, মামুনুর রশীদ রিপন ও সরোয়ার জাহানসহ নব্য জেএমবি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন গঠন করে। পরবর্তীতে তামিমের পরিকল্পনাতেই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালানো হয়। হামলার দিন সে মিরপুরের একটি আস্তানায় বসে দুই সহযোগীসহ হামলার পুরো বিষয়টি অনলাইনের মাধ্যমে দেখভাল করে। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ সদর দফতর ও কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে দুই সহযোগীসহ মারা যায় তামিম।

সরোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান: গুলশান হামলার আরেক শীর্ষ পরিকল্পনাকারী হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমানের। সরোয়ার জাহান ছিল নব্য জেএমবির আধ্যাত্মিক নেতা। গুলশান হামলার আগে সে তামিম চৌধুরীসহ পাঁচ হামলাকারীকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় বসে সর্বশেষ নির্দেশনা দেয়। সরোয়ার জাহান এক সময় পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা ছিল। তামিমের মাধ্যমে সে নব্য জেএমবিতে যোগাদান করে। সরোয়ার জাহান চাপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার দলদলি ইউনিয়নের নামো-মুশরীভূজা গ্রামের আব্দুল মান্নানের সন্তান । ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় সারোয়ারের বাড়িতে র‌্যাব অভিযান চালালে পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাতে গিয়ে নিহত হয় সে।

তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদ: হলি আর্টিজানের হামলাকারীদের আশ্রয়দাতা ও অর্থদাতা হিসেবে নাম এসেছে তানভীর কাদেরী ওরফে জামসেদের নাম। হামলার আগে বিভিন্ন সময়ে নব্য জেএমবির সদস্যদের নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতো সে। নব্য জেএমবির সাংগঠনিক পরিকল্পনা অনুযায়ী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই-ব্লকের ছয় নম্বর সড়কের টেনামেন্ট-৩ এর ফ্ল্যাট-এ /৬ ভাড়া নেয় সে। পাঁচ হামলাকারী ওই বাসাতেই ওঠেছিল। হামলার আগে অস্ত্র ও বোমা নিয়ে ওই বাসা থেকেই বেড়িয়ে যায় তারা। পরবর্তীতে তানভীর কাদেরী, তার স্ত্রী ও সন্তান, তামিম চৌধুরী, মারজান ও রাজীব গান্ধীরা ওই বাসাটি ছেড়ে চলে যায়। ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া তানভীর কাদেরীর গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম বাটিকমারি গ্রামে। তার বাবার নাম বাতেন কাদেরী। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুর এলাকায় সিটিটিসির এক অভিযানে নিহত হয় সে।

নূরুল ইসলাম মারজান: নূরুল ইসলাম মারজানকে গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারীদের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে মারজানের নাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী মারজান নিজে জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর স্ত্রীকেও জঙ্গিবাদে জড়ায়। তার বাড়ি পাবনা সদর থানার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের আফুরিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম নিজাম উদ্দিন। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে একসহযোগীসহ নিহত হয় মারজান।

বাশারুজ্জামান চকোলেট: মারজানের মতো বাশারুজ্জামান চকোলেটও শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূণ ভূমিকা রাখে। এমনকি তামিমের বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে তথ্য আদান-প্রদান ও হামলাকারীদের দেখভাল করার কাজ করতো বাশারুজ্জামান। গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ হামলাকারীর একই রঙের গেঞ্জি ও ট্র্যাক সু ও জুতা কেনার কাজটিও করেছিল বাশারুজ্জামান। তার বাবার নাম সিরাজ উদ্দিন। রাজশাহীর তানোর উপজেলার লালপুর এলাকায় তার বাড়ি। ঢাকার নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রিধারী বাশারুজ্জামান রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শ্বাশুরবাড়িতে থাকা অবস্থাতে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছাড়ে। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সিটিটিসির এক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয় বাশার।

মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান: সোহেল মাহফুজ, সাগর ও বড় মিজানের সঙ্গে গুলশান হামলায় অস্ত্র ও গ্রেনেড সরবরাহে মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজানের ভূমিকা ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। পুরনো জেএমবির সদস্য ছোট মিজান নব্য জেএমবিতে যোগ দেওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় দায়িত্বশীল পদে কাজ করেছে। তার কাজ ছিল সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাচার করে বিভিন্ন আস্তানায় পৌঁছে দেওয়া। ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সিটিটিসির এক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাশারের সঙ্গে নিহত হয় ছোট মিজান।

মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম: গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া হামলাকারীদের প্রশিক্ষক হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া মেজর জাহিদুল ইসলামের। নব্য জেএমবিতে ‘মেজর মুরাদ’ হিসেবে পরিচিত ছিল সে। গাইবান্ধা ও বগুড়ার বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় সে হলি আর্টিজানের হামলাকারীদের শারীরিক ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেয়। কুমিল্লার সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের চাঁন্দপুর এলাকার বাসিন্দা পুলিশের সাবেক পরিদর্শক নুরুল ইসলামের ছেলে জাহিদ। কানাডা যাওয়ার কথা বলে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে নব্য জেএমবির আরেক নেতা মুসার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে জাহিদ। স্ত্রী ও সন্তানসহ কথিত হিজরতের নামে ঘর ছাড়ে। ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরে সিটিটিসির জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয় জাহিদ।

রায়হান কবির ওরফে তারেক: গুলশান হামলায় প্রশিক্ষক হিসেবে রায়হান কবির ওরফে তারেক নামে আরেক তরুণের নামও তদন্তে উঠে এসেছে। মামলার অভিযোগপত্রে রায়হানকে প্রশিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গাইবান্ধায় নব্য জেএমবির একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ হামলাকারীকে প্রশিক্ষণ দেয় তারেক। তার গ্রামের বাড়ি রংপুর জেলার পীরগাছা থানার পাশুয়া টাঙ্গাইলপাড়ায়। তার বাবার নাম শাহজাহান মিয়া। ২০১৩ সালে সে একই ইউনিয়নের দামুরচাকলা এলাকার দেওয়ান সালেহ আহম্মেদ মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। এরপর ঢাকায় এসে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া তারেক ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে আট সহযোগীসহ নিহত হয়।

হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া নিহত জঙ্গিরা
রোহান ইবনে ইমতিয়াজ: হলি আর্টিজান বেকারিতে যে পাঁচ জঙ্গি সরাসরি হামলায় অংশ নিয়েছিল, তাদের দলনেতা ছিল রোহান ইবনে ইমতিয়াজ। তার সাংগঠনিক নাম আবু রাহিক আল বাঙালি। ঢাকার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ পড়া অবস্থায় অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঘর ছেড়েছিল রোহান। নব্য জেএমবির বিভিন্ন আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে সরাসরি হামলায় অংশ নেয়। রোহানের বাবার নাম ইমতিয়াজ খান বাবুল। তাদের বাসা ঢাকার লালমাটিয়ার ‘বি’ ব্লকের ৭/৯ নম্বর প্লটে। জঙ্গি হামলার পরদিন কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় রোহান।
গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গি (বাঁ থেকে) নিবরাস, মোবাশ্বের, রোহান, উজ্জ্বল ও পায়েল

নিবরাস ইসলাম: গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া নিবরাস ইসলামের সাংগঠনিক নাম ছিল আবু মুহারিব আল বাঙালি। ঢাকার টার্কিশ হোপ স্কুল থেকে ও লেভেল এবং এ লেভেল শেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথে ভর্তি হয়েছিল নিবরাস। সেখান থেকে মালয়েশিয়া গিয়ে মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। মোনাশে পড়া অবস্থায় তিউনিশিয়ান এক বন্ধুর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে নিবরাস। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফিরে আসে। এরপর ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি হিজরতের নামে ঘর ছেড়ে যায় নিবরাস। তার বাবার নাম নজরুল ইসলাম। উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের সাত নম্বর সড়কের ৩১ নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতো সে।

মীর সামিহ মোবাশ্বের: গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া আরেক জঙ্গি হলো মীর সামিহ মোবাশ্বের। তার সাংগঠনিক নাম আবু সালামাহ আল বাঙালি। স্কলাসটিকা থেকে ও লেভেল পাস করা মোবাশ্বের এ লেভেল পরীক্ষার আগে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। অন্যদের মতো মোবাশ্বেরও গাইবান্ধা, বগুড়া ও ঝিনাইদহে নব্য জেএমবির আস্তানায় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তামিম চৌধুরীর নির্দেশে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অংশ নেয়। মীর সামিহ মোবাশ্বেরের বাবার নাম মীর হায়াত এ কবির। বাবা-মায়ের সঙ্গে সে বনানীর পুরনো ডিওএইচএসের পাঁচ নম্বর সড়কের ৬৮/এ নম্বর বাসায় থাকতো। গুলশান হামলার পরদিন কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় মোবাশ্বের।

খায়রুল ইসলাম পায়েল: সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়া খায়রুল ইসলাম পায়েলের সাংগঠনিক নাম আবু উমায়ার আল বাঙালি। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর থানার চুতিনগর ইউনিয়নের ব্রিকুষ্টিয়ায়। তার বাবা আবুল হোসেন একজন দিনমজুর। পায়েল প্রথমে ব্রিকুষ্টিয়া দারুল হাদিস সালাদিয়া কওমি মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। পরে ডিহিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৩ সালে দাখিল ও ২০১৫ সালে আলিম পাস করে। হামলার এক বছর আগে থেকে নিখোঁজ ছিল সে। গুলশান হামলা ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িত ছিল। নব্য জেএমবির দায়িত্বশীল নেতা রাজীব ওরফে গান্ধী ওরফে সুভাষ ওরফে জাহাঙ্গীরের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে পায়েল। গুলশান হামলার পরদিন কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় সে।

শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ: শফিকুল ইসলাম উজ্জলের সাংগঠনিক নাম আবু মুসলিম আল বাঙালি। গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া উজ্জ্বলের গ্রামের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভাণ্ডার বাড়ি ইউনিয়নের কৈয়াগাড়ি গ্রামে। তার বাবার নাম বদিউজ্জামান বদি। উজ্জল ধুনটের গোঁসাইবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও গোসাইবাড়ি ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হয়। পরে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ঢাকার আশুলিয়া থানার শাজাহান মার্কেট এলাকায় মাদারী মাতব্বর কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেয়। তাবলিগে যাবার নাম করে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। পায়েলও রাজীব গান্ধীর হাত ধরেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গুলশান হামলায় অংশ নেয়। হামলার পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় সে।

গ্রেফতার হওয়া ছয় জঙ্গি
জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী: জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী জঙ্গি সরবরাহকারী হিসেবে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে গ্রেফতার হওয়া রাজীব গান্ধী গুলশান হামলার আদ্যোপান্ত স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। রাজীবের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের পশ্চিমরাঘরপুর এলাকার ভূতমারী ঘাট এলাকায়। তার বাবার নাম মাওলানা ওসমান গণি মণ্ডল। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এসএসসি পাস করা রাজীব ২০১৫ সালে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে ‘হিজরত’ করে। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে সে এসএসসি পাস করেছে। রাজীব বর্তমানে কারাবন্দি রয়েছে।
গ্রেফতার জঙ্গিরা (বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটার মতো) রাজীব, সাগর, মাহফুজ, বড় মিজান, রাশেদ ও রিগ্যান

আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ: গুলশান হামলার পরিকল্পনা সহযোগী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশের নাম। সে ছিল শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ট। নওগাঁর মান্দা এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে রাশেদ উচ্চ মাধ্যমিক পড়া অবস্থাতেই প্রথমে অনলাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। ঢাকায় আসার পর তামিম চৌধুরী ও মারজানের সঙ্গে থেকে জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তামিম ও মারজানের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই নাটোর থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে সে। বর্তমানে রাশেদ কারাবন্দি রয়েছে।

সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ: গুলশান হামলায় অস্ত্র ও বোমা তৈরি এবং সরবরাহকারী হিসেবে তদন্তে নাম এসেছে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজের নাম। সোহেল মাহফুজ এক সময় পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা ছিল। ২০০২ সালে পাবনা জেলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। সোহেল মূলত বোমা তৈরির কারিগর। বোমা তৈরি করতে গিয়ে তার এক হাত উড়ে যায়। ২০১৪ সালে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বোমা তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করতে থাকে। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো শেওড়াপাড়ার আস্তানায় বসে নিজের হাতেই তৈরি করেছিল সে। ২০১৭ সালের ৭ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন পুস্কনি এলাকা থেকে তিন সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয় তাকে। পরবর্তীতে কয়েক দফা রিমান্ড শেষে ২৩ জুলাই গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সোহেল। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ এলাকার সাদিপুর কাবলিপপাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম রেজাউল করিম শেখ। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।

হাদীসুর রহমান সাগর: গুলশান হামলার তদন্তে হাদীসুর রহমান সাগরের বিরুদ্ধে বোমা তৈরি ও অস্ত্র-বোমা সরবরাহের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা । মামলার অভিযোগপত্রে তার নাম থাকছে। পুরানো জেএমবির সদস্য সাগর ২০০১ সালে জয়পুরহাট সদরের বানিয়াপাড়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করার পর থেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ভারত থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আনার সবগুলো রুট জানা ছিল তার। ২০১৪ সালে সে নব্য জেএমবির হয়ে কাজ শুরুর পর হলি আর্টিজানে হামলার জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল সে। সাগরের গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের কয়রাপাড়ায়। বাবার নাম হারুন অর রশিদ। এ বছরের (২০১৮) ২১ মার্চ চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থেকে সাগরকে গ্রেফতারের পর দুই দফা রিমান্ড শেষে ৫ এপ্রিল গুলশান হামলায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। সাগর আরেক জঙ্গি মারজানের ভগ্নিপতি বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।

রাকিবুল হাসান রিগ্যান: গুলশান হামলা মামলার তদন্তে রাকিবুল হাসান রিগ্যানের নাম এসেছে হামলাকারীদের প্রশিক্ষক হিসেবে। বয়সে তরুণ রিগ্যান ২০১৫ সালে বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের ২৬ জুলাই সকালে কোচিংয়ের কথা বলে ঘর ছাড়ে রিগ্যান। নব্য জেএমবির তরুণ প্রশিক্ষক হিসেবে গাইবান্ধা ও বগুড়ার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া হামলকারীদের ধর্মীয় ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল সে। রিগ্যানের বাড়ি বগুড়ার জামিলনগর এলাকায়। তার বাবার নাম মৃত রেজাউল করিম। ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চলাকালে পালিয়ে যাওয়ার সময় রিগ্যানকে গ্রেফতার করেন সিটিটিসি’র সদস্যরা। ওই বছরের ৩ অক্টোবার গুলশান হামলায় নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রিগ্যান। বর্তমানে সে কারাবন্দি রয়েছে।

মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান: গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার সীমান্ত থেকে ঢাকায় আনার দায়িত্ব ছিল মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানের। মামলার তদন্তে উঠে এসেছে— আমের ঝুড়িতে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক ঢাকায় এনে তামিম ও মারজানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতো সে। ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বনানী এলাকা থেকে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুরনো জেএমবির সদস্য বড় মিজান চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় নব্য জেএমবি’র আঞ্চলিক সংগঠক ও সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। গ্রেফতারের পর গত বছরের ২৬ মার্চ হলি আর্টিজানে হামলার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে সে। বর্তমানে মিজান কারাগারে রয়েছে।

পলাতক দুই জঙ্গি
মামুনুর রশিদ রিপন: গুলশান হামলার পরিকল্পনা ও হামলাকারী (জঙ্গি) সরবরাহকারী হিসেবে নাম এসেছে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মামুনুর রশীদ রিপনের। এক সময় পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা ছিল রিপন। বাংলাদেশে এসে তামিম চৌধুরী যে কয়জনের সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে নব্য জেএমবি গঠন করে, রিপন তাদের মধ্যে অন্যতম। রিপন এক সময় উত্তরবঙ্গের সামরিক কমান্ডার হিসেবে কাজ করতো। গুলশান হামলায় জড়িত থাকার পাশাপাশি উত্তরবঙ্গে একাধিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত সে। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার নন্দীগ্রাম থানার চৌদীঘির মারিয়া এলাকায়। তার বাবার নাম নাছের উদ্দিন। গুলশান হামলার পর থেকেই রিপন পলাতক রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, রিপন ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করে আছে।
গুলশান হামলায় জড়িত দুই পলাতক জঙ্গি (বাঁ থেকে) মামুনুর রশীদ রিপন ও শরীফুল ইসলাম খালিদশরীফুল ইসলাম খালিদ: রিপনের মতো খালিদও হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনায় সহযোগিতা, বাস্তবায়ন ও হামলাকারী সরবরাহে ভূমিকা রেখেছিল বলে তদন্তে প্রমাণ পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খালিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম থেকেই যোগাযোগ ছিল তার। রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার শ্রীপুর এলাকায় তার গ্রামের বাড়ি। তার বাবার নাম আব্দুল হাকিম। গুলশান হামলার পর থেকে সেও পলাতক রয়েছে। রিপনের সঙ্গে সেও ভারতে আত্মগোপন করে আছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা।

বাংলাট্রিবিউন

Next Post

ফেইসবুকের বিরুদ্ধে নজরদারির অভিযোগ।

শনি জুন ৩০ , ২০১৮
কয়েক কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য কেলেঙ্কারির পর এবার ফেসবুকের বিরুদ্ধে নজরদারির অভিযোগ উঠেছে। গোপনে একটি সিস্টেমের পেটেন্ট নিয়ে তার মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের উপর নজরদারি চালাচ্ছে ফেসবুক। বিষয়টা এমন— বিভিন্ন টিভি শো কিংবা বিজ্ঞাপনে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে একটি ‘অডিও ফিঙ্গারপ্রিন্ট’। তা থেকে একটি সিগন্যাল তৈরি হবে। এতই ক্ষীণ শব্দ, সেই সিগন্যাল মানুষের কানে […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links