হবিগঞ্জের ডিসি /জেলা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সীমাহীন দুর্নীতি হয়রানি

ava desk : হবিগঞ্জের ডিসি (জেলা প্রশাসক) মাহমুদুল কবীর মুরাদ। প্রশাসন ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের এ কর্মকর্তা পোস্টিং পান গেল ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই তার আমলনামায় অদক্ষতা ও জনহয়রানির পাল্লা ভারি হয়ে উঠেছে। একদিকে জেলা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সীমাহীন দুর্নীতি হয়রানি যেমন জেঁকে বসেছে, তেমনি কোনো নথিই সময়মতো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। রুটিন ওয়ার্ক ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও জবাব প্রদানের কাজও থমকে আছে। যে কাজ দু’দিনে হওয়ার কথা তা এক মাসেও হচ্ছে না। চাহিদামাফিক দেনদরবার না হলে বেশির ভাগ ফাইলের মুক্তি মেলে না। সেবাপ্রার্থী যত বড়, এখানে ঘুষের রেটও তত বড়। ঘুষকে বলা হয় সার্ভিস চার্জ। যা না দিলে নিষ্পত্তির জন্য চূড়ান্ত ফাইলে কর্তাব্যক্তিরা স্বাক্ষর করেন না। এ ফাঁদে আটকা পড়েছে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য সেবাপ্রার্থীদের অপেক্ষমাণ জরুরি কাগজপত্রও। এজন্য সাধারণ মানুষ ছাড়াও ব্যবসায়ী শিল্পপতিসহ প্রত্যেকের দুর্ভোগের শেষ নেই।
অভিযোগ উঠেছে, জেলার নির্বাহী প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তার পারফরম্যান্স নাজুক হওয়ায় সঙ্গে থাকা এডিসিরাও হাল ছেড়ে বসে আছেন। বিশেষ করে এডিসি নুরুল ইসলাম (রাজস্ব) প্রায় প্রতিদিনই সেবাপ্রার্থীদের ক্ষোভ-অসন্তোষের মুখোমুখি হচ্ছেন। নিয়মিত অফিস না করে ব্যস্ত থাকেন নানা প্রটোকল ডিউটিতে।
এ কারণে তার দফতরে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু আবেদন-নিবেদন মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্মসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা দফায় দফায় তাগিদ দিয়েও মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। সম্প্রতি হতবাক করার মতো এমন ঘটনাও ঘটেছে।
উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিসি মাহমুদুল কবীর মুরাদ যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, এগুলো মনগড়া অভিযোগ। বরং তিনি আসার পর জেলা প্রশাসনের কাজে গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। তিনি জানান, সার্ভেয়ারদের ঘুষ নেয়ার বিষয় তার জানা নেই। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেব।
এদিকে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের নানা অভিযোগ অনুসন্ধানে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিবেদক সরেজমিন ডিসি কার্যালয়ের বিভিন্ন শাখায় অনুসন্ধান চালায়। এ সময় তথ্য-প্রমাণসহ ভোগান্তির দীর্ঘ ফিরিস্তি বের হতে থাকে।
কয়েকজন ভুক্তভোগী যুগান্তরকে জানান, তারা সার্ভেয়ারদের নির্ধারিত হারে ঘুষ কমিশন দিয়েও জমি অধিগ্রহণের টাকা বুঝে পাচ্ছেন না। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, কোনোদিন বলা হয়, ডিসি স্যার মিটিংয়ে। আজ হবে না। আবার যেদিন ডিসি অফিসে থাকেন সেদিন বলা হয়, এডিসি স্যার অসুস্থ কিংবা ঢাকায় গেছেন। কখনও বলেন, আরও টাকা দেয়া লাগবে।
এভাবে আগাম এসব কমিশন কেন দিচ্ছেন জানতে চাইলে তারা জানান, আগেভাগে বড় স্যারদের ভাগ না দিলে অধিগ্রহণের চেক নাকি পাওয়া যাবে না। এটাই এখানে নিয়ম। কেউ প্রতিবাদ করলে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ফাইলে কঠিন ফাঁকফোকর বের করাসহ কাগজপত্রে বড় ত্রুটি আছে বলে রিপোর্ট দেয়া হবে। এরপর কোনো টাকায় পাওয়া যাবে না। মামলা-মোকদ্দমা করতে হবে। সেজন্য ভোগান্তি এড়াতে তারা আগাম টাকা কিংবা চেকে স্বাক্ষর দিচ্ছেন।
ভুক্তভোগীরা আরও জানান, ডিসি ও এডিসি স্যারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা দুই সার্ভেয়ার এসব হয়রানির নাটের গুরু। এরা হলেন সার্ভেয়ার অরুন কুমার দত্ত ও মীর মোহাম্মদ শাহীন। কাগজপত্র সঠিক থাকলেও টাকা ছাড়া তাদের কাছে কাজ হয় না। কি সরকারি কর্মকর্তা, কি উকিল, আর কি সাধারণ মানুষ কেউই ভোগান্তির ঊর্ধ্বে নন। মসজিদ, মন্দিরের সবকিছুতেই ঘুষের হিসাব কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেয়া হয়। তাই মসজিদের ভূমি অধিগ্রহণের টাকা নিতেও তাদের খুশি করতে হয়েছে।
সরেজমিন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে অসংখ্য ভোগান্তির কাছ থেকে এ রকম নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। ডিসি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন সদর উপজেলার ধুলিয়াখাল এলাকার বাসিন্দা আবদুল মজিদ, আবদুর রহমান, আবদুল কাদিরসহ বেশ কয়েকজন। তারা বলেন, হাঁটতে হাঁটতে কয়েক জোড়া জুতো গেছে। তবুও টাকা মিলছে না। ইতিমধ্যেই সার্ভেয়ার অরুন কুমার দত্ত ও সার্ভেয়ার মীর মোহাম্মদ শাহীনকে অনেক টাকাও দিয়েছেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না। তাদের চাহিদা অনেক বেশি। চাহিদা পূরণ করতে না পারায় তাদের হাঁটার পালা বাড়ছে বৈ কমছে না। কাগজপত্র ঠিকঠাকমতো দেয়ার পরও তাদের মাসের পর মাস হাঁটতে হচ্ছে। আর এখন বলা হচ্ছে কর্মকর্তা নেই। এ অবস্থায় তারা আদৌ টাকা পাবেন কিনা বা পেলে কখন পাবেন তা নিয়ে তাদের শঙ্কার শেষ নেই।
ধুলিয়াখাল এলাকায় গিয়ে কথা হয় বৃদ্ধ তৈয়ব আলীর সঙ্গে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, জমি অধিগ্রহণের টাকা পেলে হজে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এবার তার আর হজে যাওয়া হল না। বাকি জীবনে হজে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। কেননা তার শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সার্ভেয়ার অরুন কুমার দত্তকে টাকাও দিয়েছেন। কিন্তু আজ না কাল বলে ঘুরাচ্ছেন।
তিনি বলেন, কার কাছে বিচার দেব। ডিসি স্যারের অফিসে গিয়েও দেখা করতে পারিনি। উনারা শুধু মিটিং করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। কিন্তু মিটিং আর শেষ হয় না। অপর এক ভুক্তভোগী বৃদ্ধ রমজান আলী জানান, তিনি নিঃসন্তান। তাই কিছু জমি বিক্রি করে মসজিদে দান করে দিয়েছেন। এখন সরকারের অধিগ্রহণ করা ১৮ শতাংশ জমির টাকা পেলে তিনি তাও মসজিদে দান করে দেবেন। কিন্তু সে টাকাও তো মিলছে না। তিনি জানান, শরীরের অবস্থা বেশি ভালো নয়। তাই তার পক্ষে সব সময় এত পথ ঠেলে ডিসি অফিসে আসা সম্ভব হয় না। তার এক ভাতিজাকে খবর নেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন। এভাবেই হতাশার কথা জানান ডিসি অফিসে উপস্থিত বৃদ্ধ আবদুল গফুর ও আবু মিয়া। তারা বলেন, অফিসে হাঁটতে হাঁটতে কয়েক জোড়া জুতো গেছে। কিন্তু ফল মিলছে না। একেকবার গেলে একেক কাগজের কথা বলে। এখন বলছে অফিসার নেই। এদিকে সেবাপ্রার্থী পরিচয়ে সার্ভেয়ার অরুন কুমার দত্তের সঙ্গে একাধিকবার কথা বললে ঘুষ বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। তিনি অনেকটা দাপটের সঙ্গে প্রতিবেদককে বলেন, ‘হাইকোর্টের কত উকিল, আর সিনিয়র আইনজীবীরা এসে ঘুরে গেল, কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। বরং আমি দেখলেই বলে দিতে পারি টাকা পাবে কিনা। দম্ভ করে বলেন, দু’জন সিনিয়র উকিলের টাকার ব্যবস্থা আমিই করে দিয়েছি। আরেকজন হাইকোর্টের উকিল শেষ পর্যন্ত আমাকে খুশি করে গেছেন। খরচাপাতি দিয়ে বলে গেছেন, কাজ শেষ হলে আমি যেন খবর দিই। আমি তাকে বলেছি, কাজ শেষে জানাব। তখন এসে জামাইয়ের মতো টাকা নিয়ে যাবেন।’ এরপর প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আপনিও এভাবে হেঁটে কোনো লাভ পাবেন না। সারা বছর হাঁটলেও কোনো কাজ হবে না। কাগজপত্র নিয়ে আসেন। আমি দেখি। তারপর বলে দেব কি করতে হবে।’ খরচের হিসাব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খরচ তো কিছু লাগবেই। তবে কাগজ দেখে বলব কত লাগবে।’ পরে যুগান্তর প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে তার কাছে টাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বেমালুম সব কথা অস্বীকার করেন। প্রতিবেদকের কাছে টাকা চাওয়ার প্রমাণ আছে উল্লেখ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আসলে আপনাকে চিনতে পারিনি। তাই হয়তো বলেছি।’ বানিয়াচংয়ের মিনাট জামে মসজিদের কিছু জমি অধিগ্রহণে টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা এখনও টাকা নেয়নি। শুধু দরখাস্ত করেছে। এতে কিছু ত্রুটি ছিল ঠিক করে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।’ টাকা নেয়ার বিষয়টি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যান। আরেক সার্ভেয়ার মীর মোহাম্মদ শাহীনকে অফিসে না পেয়ে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি হয়রানির বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, যারা বলেছে তাদের কাগজপত্র ঠিক নেই। কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে আসতে বলেছি। এক মাসের মধ্যে আনতে না পারলে ফাইল বাতিল করা হবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ জানান, ধুলিয়াখাল এলাকায় মিটিং করে তিনি কাউকে টাকা লেনদেন না করার জন্য বলেছেন। কাগজপত্র ঠিক থাকলে কেউ যেন কারও সঙ্গে কোনো টাকা লেনদেন না করে সরাসরি তার সঙ্গে যোগযোগ করে সে পরামর্শ দেন। কেউ টাকা চাইলেও যেন তাকে জানায়। তবে সার্ভেয়ারদের টাকা চাওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।
প্রসঙ্গত, জেলার সদর উপজেলার ধুলিয়াখাল এলাকায় বিজিবির ক্যাম্প করার জন্য ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। যার এলএ কেইস নং ৭/২১৫-২০১৬। অধিগ্রহণকৃত জমির মাঝে চতুল মৌজায় ৩.২৮ একর এবং নূরপুর উত্তর মৌজায় ২১.৭২ একর। এখানে কোনো খাস জমি নেই। পুরো অংশই মালিকানা। ২০১৬ সালের মে মাসে ওই জমির অধিগ্রহণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত গত ২ বছরে টাকা পেয়েছেন মাত্র প্রায় ৪০ শতাংশ জমির মালিক।

jugantor

Next Post

বরগুনার তালতলী উপজেলার ভূমি অফিস দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

সোম জুলাই ২৩ , ২০১৮
আভা ডেস্ক : বরগুনার তালতলী উপজেলার ভূমি অফিস দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। টাকা না দিলে নিষ্পত্তি হয় না কোনো কাজ। ফাইল ঝুলে থাকায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন এই উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা রহমান তালতলীতে আসার পর থেকেই মূলত হয়রানি আরও বেড়েছে। […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links