সিঁড়ির চৌকিতে পড়ে আছে, গলায় গুলির রক্তাক্ত দাগ। এখনও গুলির দাগটি ভেসে ওঠে।

আভা ডেস্ক : শোকাবহ ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ফজলুল হক মনির ছেলে তাপস বলেন, অন্যদের বাবা-মায়ের কত স্মৃতি। আমারও তো ইচ্ছে করে অন্যদের মতো বাবা-মায়ের স্মৃতিচারণ করতে। আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, অনেক ভেবেছি, অনেক চিন্তা করেছি, অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোনো স্মৃতিই পাইনি। শুধু আবছা আবছা একটি স্মৃতি। তিনি বলেন, আমার বাবা-মার স্মৃতি বলতে শুধু মেঝেতে পড়ে থাকা নিথর রক্তাক্ত দুটি লাশ। এ ছাড়া আমি আর কিছুই মনে করতে পারি না! মঙ্গলবার বিকালে ধানমণ্ডির নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে এমন আবেগজড়িত কণ্ঠে সেদিনের স্মৃতিচারণ করেন ফজলে নূর তাপস।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারান তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মনি এবং মা আরজু মনি। বাবা-মাকে হারিয়ে তাপস ও তার ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ এতিম হয়ে পড়েন। এ সময় তাপসের বয়স ছিল চার বছর এবং পরশের ছয় বছর। বঙ্গবন্ধুর বোন শেখ আছিয়া বেগমের বড় ছেলে মনি ছিলেন আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা। স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম প্রধান গেরিলা বাহিনী ‘মুজিব বাহিনী’ তার নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছে।

ব্যারিস্টার তাপস বলেন, আমি তখন অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এখন বুঝ হলেও মনকে বুঝ দিতে পারি না। কোনো সন্তান যখন ঘরে ফিরে যায় তখন কেন তার মাকে পাবে না! কেন তার মাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। কেন তার মাকে সেবা করতে পারবে না! স্মৃতির মণিকোঠায় ভেসে ওঠা দৃশ্যপট বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাতি তাপস বলেন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে শুধুই বাবার লাশ, সাদা গেঞ্জি পরা। সিঁড়ির চৌকিতে পড়ে আছে, গলায় গুলির রক্তাক্ত দাগ। এখনও গুলির দাগটি ভেসে ওঠে। আরেকটি দৃশ্য স্মৃতিতে আটকে আছে- বাবা-মার লাশ নিয়ে যাওয়ার পর সিঁড়িতে পড়ে থাকা জমাট বাঁধা রক্ত। এর বেশি কিছু মনে নেই। মনে নেই বাবা-মার আদর-আলিঙ্গন, হাসি-কান্না। তাপস বলেন, আগস্ট মাসের প্রথম দিন থেকেই আমাদের বুকের ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। আমাদের মনটা কালো ছায়ায় ঢেকে থাকে। বিচার হয়েছে বলে তবুও এখন একটু সান্ত্বনা পাই। আমি নিজেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছি। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন এই বিচার না দেখে বুকভরা কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন। এখনও অনেক খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা এসব আসামিকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানান তিনি। জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে তাপস বলেন, আত্মীয়দের বাসায় কিছু দিন লুকিয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। প্রায় দুই বছর এভাবে লুকিয়ে চলার পর ১৯৭৮ সালে আমরা ভারতে চলে যাই। দাদি আমাদের সেখানে নিয়ে যান। চাচারা সবাই আগেই ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

কিছু দিন ভারতে থাকার পর আবার আমরা দেশে ফিরে আসি। তিনি বলেন, আমরা যখন বাসা ভাড়া নিতে যেতাম, আমাদের কেউ বাসা ভাড়া দিত না। আমরা বাসা ভাড়া পেতাম না। আত্মীয়দের বাসায় থাকতাম। অনেক দিন পর লালমাটিয়ার একটি বাসায় উঠি। আমাদের পড়ালেখা করতেও বাধা দেয়া হতো। ভর্তি হতে দেয়া হতো না। আমাদের স্কুলেও বেশি দিন থাকতে দেয়া হতো না। স্কুল কর্তৃপক্ষ শঙ্কার মধ্যে থাকত। অনেক কষ্টে পড়ালেখা করতে হয়েছে আমাদের।

দাদা-দাদি, দুই চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, সর্বোপরি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অবদানের কথা স্মরণ করেন তাপস। তিনি বলেন, তাদের ভালোবাসা, আদর ও স্নেহে আজ এ অবস্থানে আসতে পেরেছি। তিনি বলেন, আমাদের এতিম দুই ভাইয়ের একমাত্র ছায়া ছিলেন আমার দাদি বঙ্গবন্ধুর মেজ বোন শেখ আছিয়া বেগম। তাপস বলেন, আমাদের বোঝানোর জন্য দাদি বলতেন, বাবা-মা বিদেশে আছে। তোমরা কেঁদো না, এই তো চলে আসবে। কিছু দিন পরই চলে আসবে।

ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা যখন বুঝতে শিখলাম যে বাবা-মাকে আর পাব না, তাদের অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই সময় আরেকটি উপলব্ধি এলো, ওই অন্যায়ের কোনো বিচার আমরা পাব না। বিষয়টি দীর্ঘদিন আমাদের তাড়িত করেছে। বিচারহীনতার কষ্ট অন্য রকম। আমার মৌলিক অধিকার কিন্তু সেটি আমাকে দেয়া হবে না! ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যখন বিচার কার্যক্রম শুরু হল, নতুন এক শঙ্কায় পেয়ে বসল। বিচার সম্পন্ন করতে পারব তো! দীর্ঘ ৩৪ বছর পর সেই বিচারের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। ফাঁসির আদেশও কার্যকর হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী হওয়ায় দু’বার হামলার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তাপস বলেন, পুরানা পল্টনের বাংলার বাণী অফিসে তার ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগেই ওই হামলার পরিকল্পনা করা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যাই। এরপর হাজারীবাগের পার্কের মধ্যে দ্বিতীয় হামলার শিকার হই। তিনি বলেন, এসব হামলার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তাদেরই প্রচেষ্টা ছিল এটা। তাদের প্রচেষ্টা এখনও আছে, ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। ১৫ আগস্ট তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করেন না ফজলে নূর তাপস। সকালে ওঠে নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করেন। এরপর দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধানমণ্ডি ৩২-এ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বনানী কবরস্থানে নিহত আত্মীয়স্বজনের কবরে দোয়া ও মোনাজাত করেন। ফুফু শেখ হাসিনার সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বাসায় ফিরে তিনি একাকী থেকে নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া মোনাজাত করেন।
যুগান্তর

Next Post

একপর্যায়ে ১৫ আগস্টের ঘটনায় কোনো মামলা করা যাবে না

বুধ আগস্ট ১৫ , ২০১৮
Ava desk : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় ঢাকার মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহত হন। এ ঘটনার দীর্ঘদিন পর মামলা হলেও বিচার কাজ শেষ হচ্ছে না। এক যুগ আগে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন (অভিযোগ) করা হয়। আদালতে সাক্ষী না আসায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links