রুয়েট নিয়োগ বানিজ্যের নেপথ্য নায়ক, “ওরা”

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েটে) উপাচার্য রফিকুল ইসলাম সেখ তার আত্মীয়-স্বজনের চাকরি দিতে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন। নিয়োগের আগেই রাজশাহীর কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সমঝোতায় যান তিনি। তাদের তদবিরে নিয়োগ দেন অধিকাংশকে। বিনিময়ে ভিসির শ্যালক, দুই ভাই, স্ত্রীর ফুফাতো ভাই, চাচাতো বোন, গৃহকর্মী ও তাঁর স্বামীসহ অন্য আত্মীয়দের নিয়োগ নিয়ে ওইসব ব্যক্তির কেউই হস্তক্ষেপ করেননি। এই প্রক্রিয়ার ‘মিডলম্যান’ হিসেবে কাজ করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা, রুয়েটের এক শিক্ষক ও একজন প্রকৌশলী। তাদেরকে একসঙ্গে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ হিসেবে চেনেন রুয়েট সংশ্লিষ্টরা।

থ্রি মাস্কেটিয়ার্সরা হলেন রাজশাহী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক অরবিন্দ দত্ত বাপ্পী, রুয়েট ছাত্রকল্যাণ উপ-উপদেষ্টা অধ্যাপক মামুনুর রশিদ ও প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ। তাদের প্রত্যেকেই নিয়োগ দুর্নীতির ‘মিডলম্যান’ হিসেবে কাজ করার বিপরীতে নিজেদের স্বজন ও পরিচিতদের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ার মূল পরিকল্পনাকারী অরবিন্দ দত্ত বাপ্পী নিজে স্ত্রী ও শ্যালকসহ বেশ কয়েকজনের জন্য চাকরি নিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করা অরবিন্দ দত্ত বাপ্পী ২০১০ সালে বিস্ময়করভাবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এরপর থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়ান। ২০১২ সালে স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজশাহী মহানগর কমিটির দপ্তর সম্পাদক হন। ২০১৭ সালে সেই পদে থেকেই বিদেশী একটি দেশের স্থানীয় দূতাবাসে চাকরি পান। নিয়মবহির্ভূতভাবে রাজনৈতিক পদে থাকার তথ্য দূতাবাস কর্তূপক্ষের কাছে গোপন করে সেখানে চাকরি করেন। দূতাবাসের পরিচয় দিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন রাজশাহীর প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনীতিবিদের। অন্যদিকে সম্পর্ক গড়ে ওঠে রুয়েটের শিক্ষক মামুনুর রশিদ ও প্রকৌশলী হারুন রশিদের সঙ্গে। তাদের মাধ্যমেই তার যোগাযোগ তৈরি হয় রুয়েট ভিসির সঙ্গে। এরপর থেকেই শুরু হয় নিজেদের লোকজন নিয়োগ দেওয়ার এই পরিকল্পনা। এর অংশ হিসেবে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রভাবশালী নেতাদের ম্যানেজ করার।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বৈঠক করেন রাজশাহীর এক শীর্ষ সরকারদলীয় নেতার দুই ঘনিষ্ঠ জনের সঙ্গে। তারাও রুয়েটে চাকরি করেন। তাদেরকে পরিকল্পনায় যুক্ত করেই প্রভাবশালী ওই নেতাকে ম্যানেজ করা হয়। তাদের আস্থা অর্জনের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম অবস্থায় রুয়েটের ঠিকাদারি কাজ প্রভাবশালী ওই নেতার হাতে তুলে দেয়ার বিষয়ে ভিসি একমত হন। সে অনুযায়ী ৪টি বড় নির্মাণকাজ তাদের পছন্দের লোককে দেয়া হয়। ফলে অরবিন্দ ও থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের ওপর আস্থা বাড়ে তাদের। এরপর তারা জানিয়ে দেন, তাদের হয়ে রুয়েটের নিয়োগপ্রার্থী চূড়ান্ত করবেন রুয়েটে কর্মরত তাদের দুই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।

নিয়োগের প্রক্রিয়া এগিয়ে পরিকল্পনা অনুসারে কতিপয় অসৎ সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার ভার নেয় অরবিন্দ। দূতাবাসে চাকরির সুবাদে তার সঙ্গে রাজশাহীর সাংবাদিকদের ভালো যোগাযোগ ছিলো। এছাড়া আরএমপি ইউনিটের এক অফিসার তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় অরবিন্দ তার কাছ থেকে বেআইনিভাবে রেকর্ড সংগ্রহ করে বিভিন্নভাবে বিভিন্নজনকে ব্লাকমেইল করে নিজের পক্ষে আনে। এরপরেও যাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিলো, তাদেরকে ম্যানেজ করতে রাজশাহীর প্রভাবশালী একটি সাংবাদিক সংগঠনের সদ্য নির্বাচিত দুই শীর্ষ নেতাকে রুয়েটের একটি ঠিকাদারি কাজ ও অন্য কয়েকজনকে চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়। ওই দুই সাংবাদিক নেতার হাতে রুয়েটের ১৫ কোটি টাকার একটি নির্মাণকাজ তুলে দেয়া হয়। নাটোরের এক ঠিকাদারের লাইসেন্সে রাজশাহীর স্থানীয় এক ঠিকাদার এই কাজটি দুই সাংবাদিক নেতার কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা দিয়ে কিনে নেন। অরবিন্দ দত্তের নেতৃত্বে রুয়েটের থ্রি মাস্কেটিয়ার্স গ্রুপও এখান থেকে পান অর্ধকোটি টাকা।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর আঁটঘাট বেঁধে থ্রি মাস্কেটিয়ার্সকে নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেন ভিসি রফিকুল ইসলাম সেখ। নিজের শ্যালক, দুই ভাই, স্ত্রীর ফুফাতো ভাই, চাচাতো বোন, গৃহকর্মী ও তাঁর স্বামীসহ স্বজনদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে তিনি পরিকল্পনা মোতাবেক অন্যদের প্রার্থীদেরও নিয়োগ নিশ্চিত করেন। থ্রি মাস্কেটিয়ার্সও পেয়ে যান তাদের ভাগ।  মামুন ও হারুন তাদের ভাগের চাকরি অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। হারুন শুধু তার কোটা থেকে তার ভাই সাবেক ছাত্রশিবির নেতা মামুনুর রশিদকে টেকনিক্যাল অফিসার পদে অভ্যন্তরীণ প্রার্থী দেখিয়ে চাকরি নিয়ে দেন। আর অরবিন্দ তার ভাগে পাওয়া চাকরির মধ্যে কয়েকটি বিক্রি করেন আর বাকি তিনটি চাকরি ভাগ করার ব্যবস্থা করেন নিজের স্ত্রী ও শ্যালকের মধ্যে। সেই হিসাবে অরবিন্দ স্ত্রী রিঙ্কী রাণী সাহা রুয়েট কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বুক শর্টার এবং শ্যালক শ্যাম সুন্দর গবেষণা ও সম্প্রসারণ বিভাগের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি হিসাবে চাকরি নিয়ে দেন।

রুয়েটের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এরা সবাই এতোটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে তারা কাউকেই পরোয়া করেন না। প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্সকেও তদন্তের আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করেন তারা।

এদিকে দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে অরবিন্দ দত্ত বাপ্পী দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ তৈরি করেন হুন্ডি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। তাদেরকে বিভিন্ন বেআইনি সুবিধাও দিতেন তিনি। রুয়েটের এই দুর্নীতির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিয়ে দূতাবাসে অভিযোগ যায়। এরপর তার রাজনৈতিক পদ গোপন করে তার চাকরি ও বিভিন্ন অসাধু মহলের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ উঠলে সেই দূতাবাস থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় অরবিন্দকে।

রুয়েটের নিয়োগ নিয়ে এই দুর্নীতির খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে গত ২১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। রুয়েট সংশ্লিষ্টদের দাবি, শুধু ভিসি নয়, এই নিয়োগের সুবিধা যারা যারা নিয়েছেন, তাদের সবারই নাম সামনে আসা উচিৎ।

এ ব্যাপারে পর পর দুইদিন রুয়েটে গিয়ে ভিসি রফিকুল ইসলাম শেখকে পাওয়া না যাওয়ায় বারংবার তাঁর মোবাইল ফোনে ফোন দিলে তিনি ফোন ধরেননি।

রুয়েট ছাত্রকল্যাণ উপ-উপদেষ্টা অধ্যাপক মামুনুর রশিদ বলেন, এখন কথা বলতে পারবো না। আমাকে বিকেল ৫ টায় ফোন দিবেন।

প্রকৌশলী হারুনুর রশিদকে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন বলেন আমার উপর আনিত অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দ্যেশ্যে প্রনোদিত। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও সামাজিক মানক্ষুন্নের অপ্রচার করছে একটি চক্র।

এ বিষয়ে অরবিন্দ দত্ত বাপ্পীকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

Next Post

টিপুকে হত্যার ৫ দিন আগে কন্টাক্ট পায় শুটার মাসুম

রবি মার্চ ২৭ , ২০২২
আভা ডেস্কঃ রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী প্রীতি হত্যার ঘটনায় জড়িত একমাত্র শুটার মাসুম ওরফে মো. আকাশকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ। হত্যার ৫ দিন আগেই এই খুনের কন্টাক্ট পায় মাসুম। তিন দিন আগে নাম পায় কাকে খুন করতে হবে। শুধু তাই […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links