রেজাউল করিম, রাজশাহী: রাজশাহীতে শনিবার মধ্যরাতে প্রচারণা বন্ধ হলেও মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের বাসাবাড়ি ও চায়ের দোকানগুলো হয়ে ওঠে অঘোষিত প্রচার কেন্দ্র। এতদিন প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরনা দিলেও এ সময় ভোটারদের অনেকে প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঘোরেন। রোববার কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর বাসাবাড়িতে সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে। দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়েই দিনটা শুরু করেন রাজশাহীর প্রভাবশালী দুই মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। বেলা ১১টার দিকে বুলবুল উপশহরের বাসা থেকে বের হয়ে কিছু অভিযোগ নিয়ে হাজির হন নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে। ওই সময় তার সঙ্গে দলের বেশকিছু নেতাকর্মীও ছিলেন। নির্বাচন কমিশনে ঢুকেই বুলবুল সাংবাদিকদের সামনে একগাদা অভিযোগ পেশ করেন। একই সঙ্গে একটি লিখিত অভিযোগও তিনি দাখিল করেন নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে।
নির্বাচন অফিসারের দফতর থেকে বেরিয়েই বুলবুল উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দলের নেতাকর্মীদের অব্যাহতভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। অনেককে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনেকের বাবা-মাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তিনি খুব শঙ্কায় আছেন।
বুলবুল সাংবাদিকদের আরও বলেন, এ পর্যন্ত তিনি মোট ২১টি অভিযোগ দাখিল করেছেন রিটার্নিং অফিসারের দফতরে। কিন্তু কোনো অভিযোগেরই প্রতিকার পাননি। ফলে তিনি এবারে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে গভীর শঙ্কার কথা আবারও জানিয়ে দেন।
একইভাবে বুলবুলের সঙ্গে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুও সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মিনু বলেন, নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা যে কোনো মূল্যে তা প্রতিরোধ করব। আমরা বুকের রক্ত দিয়ে হলেও জনগণের আমানত রক্ষা করব।
ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হওয়া নিয়ে বিএনপির মেয়র প্রার্থী বুলবুল সন্দিহান ও শঙ্কিত হলেও স্বস্তি ও নির্ভয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি এবারের নির্বাচনে অনিয়মের কোনো আশঙ্কাই দেখছেন না। লিটন তার জয়ের ব্যাপারেও খুব আশাবাদী। লিটন বলেন, বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নৌকার জোয়ার দেখে হতভম্ব হয়ে গেছেন। রাজশাহীতে নৌকা প্রতীকের জয়জয়কার দেখে বুলবুল হতাশা থেকেই অব্যাহতভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন, যেসব অভিযোগের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, রোববার মেয়র প্রার্থী লিটন সারা দিন বাসায় ও বাসার বাইরে যেখানেই শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন সেখানেই মানুষের ঢল নেমেছে। ডাবলুর অভিযোগ- লিটন ভাই যখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন, বিএনপির প্রার্থী তখনও অভিযোগ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন কমিশনে। রোববার দুপুরের দিকে বুলবুল যখন শুধু অভিযোগই করে যাচ্ছিলেন লিটন তখন মসজিদে নামাজ আদায় করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে করমর্দন ও কুশল বিনিময় করছিলেন। এ সময় লিটনকে দেখে সাধারণ মানুষও মসজিদের চারপাশে ভিড় করেন। লিটনকে আগাম অভিনন্দনও জানান অনেকে।
দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, তফসিল ঘোষণার কয়েক মাস আগে থেকেই লিটন চষে বেড়িয়েছেন রাজশাহী নগরীর পাড়া-মহল্লা। দলের ও ৮৫টি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী লিটনের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। অতীতের উন্নয়ন ও ব্যক্তি ইমেজের কারণে রাজশাহীতে লিটন তার জয়ের ব্যাপারে অনেকটাই নির্ভয়ে রয়েছেন।
রোববার লিটন বলেছেন, তিনি এবার কমপক্ষে ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার ভোট পাওয়ার আশা করেন। লিটনের এ দাবিকে সমর্থন করেন সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহা. জামাত খানসহ অনেক পেশাজীবী মানুষ।
জামাত খান বলেন, ৫ বছরের উন্নয়নবঞ্চনা টের পেয়ে এবার শুধু উন্নয়নের আশায় লিটনকে সমর্থন করছেন নবীন-প্রবীণ দুই প্রজম্মের মানুষ। এবারে লিটনের বিজয় সুনিশ্চিত বলে তিনি মনে করেন।
৩২ হাজার নতুন ভোটারের অধিকাংশই নৌকার বাক্সে পড়বে বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখছে এবং সেই স্বপ্নের দিক নিদেশক হিসাবে মনে করছে লিটনকেই।
অপরদিকে নিজেদের পথসভায় নিজেরাই পরিকল্পিতভাবে ককটেল ফাটিয়ে বিস্ফোরণের মামলায় জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টুর গ্রেফতারের ঘটনা বুলবুলের প্রচারণায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ওই ঘটনার তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নগরবাসীর মধ্যে জানাজানি হলে বুলবুলের দিক থেকে তারা মুখও ফিরিয়ে নেয়। এমনকি দলীয় নেতাকর্মীরাও বুলবুলের পাশ থেকে সরে গেছেন তখন থেকেই।
বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করে বলেন, বুলবুল মেয়রথাকাকালীন দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন করেন। এমনকি আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ও নেতাকর্মীদের মাঠে ফেলে রেখে ঢাকায় আত্মগোপন করেন। এ ছাড়াও রাজশাহী মহানগর ও জেলা কমিটি গঠন নিয়ে দলের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে বুলবুল দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। এসবই বুলবুলকে পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতাও। এ ছাড়াও বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রকাশ্যে ও গোপনে নৌকার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় জয়ের ব্যাপারে নিজেও বারবার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বুলবুল। এর বাইরে বিএনপির অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীও এবার বুলবুলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মী গোপনে লিটনকেই সমর্থন দিয়েছেন। যার ফলে বুলবুল শিবিরে হতাশা বিরাজ করছে গত এক সপ্তাহ ধরে। ভোটের দিন যতই এগিয়ে এসেছে বুলবুলের মাঠের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে বলে দাবি করেন বিএনপির নগর কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মামুনুর রশীদ মামুন।
বিএনপির নেতারা আরও জানান, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী লিটনের প্রচারণায় সব ধরনের মাধ্যমকে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু বুলবুলের পোস্টারই নগরীর সব জায়গায় পাঠানো হয়নি। পোস্টার তদারকির জন্য কর্মীদেরও উৎসাহ ছিল না নানা কারণে। এমনকি ধানের শীষের প্রচার ক্যাম্পগুলো কর্মীশূন্য হয়ে পড়ে খরচ না দেয়ার কারণে।
তবে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল অবশ্য কোনো অভিযোগই স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের চরম পক্ষপাতিত্বের কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা ঠিকমতো মাঠে নামতে পারেনি। তাছাড়া ভোট কারচুপি ও জালিয়াতি ছাড়া তাকে হারানো যাবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
এদিকে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হওয়ার পর থেকে রাজশাহীর নগর পিতা কে হচ্ছেন তা নিয়ে দিনভর আলোচনাও ছিল নগরবাসীর মাঝে। রোববার বিকালে লক্ষ্মীপুর, কোর্ট একাডেমি, ল্যাবরেটরি স্কুল, লোকনাথ স্কুলসহ বেশ কয়েকটি ভোট কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে নৌকা প্রতীকের পোস্টারের ছড়াছড়ি। সেখানে কেন্দ্রগুলোর বাইরে কিছু কাউন্সিলর প্রার্থীর ব্যানার-পোস্টার দেখা গেলেও ধানের শীষের কোনো পোস্টার চোখে পড়েনি।
অন্যদিকে আজকের নির্বাচন উপলক্ষে নগরীতে ঘনঘন চলাচল করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি। ভোটের সরঞ্জামবাহী গাড়িও দেখা গেছে বিভিন্ন সড়কে। নগরীর চায়ের স্টলগুলো হয়ে পড়েছে প্রার্থীদের অস্থায়ী প্রচার কেন্দ্র। দিনভর বৃষ্টির মধ্যেও ভোট গ্রহণে নিয়োজিত কর্মীরা নিজ নিজ কেন্দ্রে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। এদিকে ভোট উপলক্ষে বহিরাগতরা নগরী ছেড়ে যাওয়ায় শহরে লোকজনের চলাচলও কিছুটা কমেছে। সন্ধ্যার পর থেকে বিজিবি ও পুলিশের টহলও শুরু হয়।