রাজধানীর মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ। যেখানে রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকায়।

আভা ডেস্কঃ রাজধানীর মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ। যেখানে রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকায়। অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পদ সৃষ্টি করে নানা খাত থেকে তুলে নিয়েছেন বিপুল অংকের টাকা। শিক্ষক না হয়েও নিয়েছেন ৫৩ লাখ টাকা কোচিং বিল। যদিও কোনোদিন তিনি কোচিং নেননি। চাকরি জীবন শেষে বিদায় বেলা একবার ফেয়ারওয়েল নেয়ার কথা।

কিন্তু সৌভাগ্যবান এ ব্যক্তি তিনবার খাতা-কলমে ফেয়ারওয়েল বা বিদায় সংবর্ধনা নিয়েছেন। অবশ্য বাস্তবে তিনি এখন পর্যন্ত বিদায় নেননি। পরিচালক পদে দিব্যি কর্মরত আছেন। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে তার ব্যাংক হিসাবে তিন দফায় ফেয়ারওয়েল বাবদ ১ কোটি ১০ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছেন।

অপরদিকে হিসাবরক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক তহবিলে জমা দেন না। অথচ শিক্ষার্থীদের যে রশীদ দেয়া হয় তাতে ব্যাংকের সিল-স্বাক্ষর রয়েছে। ভয়াবহ এ জালিয়াতি করেও টিকে আছেন এ হিসাবরক্ষক। তার দুই ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই লেনদেন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি ছাত্রী নিপীড়কও।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের পরিচালনা কমিটির রেজুলেশন অনুযায়ী পরিচালকই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হর্তাকর্তা। অসীম ক্ষমতাবান এ পরিচালকের নাম সৈয়দ মনিরুল ইসলাম। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী বর্তমানে তার বয়স ৭৫ বছর ৬ মাস। ১৯৭৩ সালের বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের এ কর্মকর্তা এডিশনাল ডিআইজি হিসেবে ২০০১ সালে অবসরে যান। পরে তিনি এ কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। এখন আছেন পরিচালক পদে। নিজের সুবিধা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটিও সাজিয়েছেন তিনি। পুত্রবধূও এ পরিচালনা কমিটির সদস্য। প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েকজনকে নিয়ে যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তারা প্রত্যেকেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-তালাশ করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন ও অপারেশন) মইনুর রহমান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘যে সব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সে বিষয় খতিয়ে দেখতে আইজিপি স্যার তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনো ব্যক্তি বিশেষের কারণে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্ণ হলে কোনোভাবেই তা সহ্য করা হবে না।’

পরিচালকের যত অনিয়ম : সৈয়দ মনিরুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের কোনোদিন কোচিং ক্লাস নেননি। অথচ ২০০১ সালের ২৮ জুলাই থেকে ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত অধ্যক্ষের দয়িত্ব পালন করে ৮ বছরে কোচিং বিলের নামে তিনি নিয়ে গেছেন ৮ লাখ টাকা। ওই সময় বেতন নেন ১৬ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এরপর ২০০৯ সালে বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় তিনি অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর গ্রহণে বাধ্য হন। এ সময় কলেজ থেকে ফেয়ারওয়েল (বিদায়কালীন) মানি নামে প্রথমবার ১০ লাখ টাকা পেনশন নেন। কিন্তু বাস্তবে তাকে ফেয়ারওয়েল দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বরের আগে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে পেনশনের কোনো নীতিমালাই ছিল না। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু পরিচালক পদে থেকেই বেতন ভাতা নিয়েছেন ১ কোটি ৮০ লাখ ৯১ হাজার ১৫০ টাকা। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও থেকে তার কোনো মাসিক আয় নেই। অথচ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তার একটি ব্যাংক হিসাবে শুধু নগদ জমা হয়েছে ৫০ লাখ ৫০০ টাকা। একই হিসাবে কোচিং বিলের পাওনা হিসেবে ঢুকেছে ৫৩ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৩ সালে দ্বিতীয় বার ২৫ লাখ টাকা নেন ফেয়ারওয়েল মানি। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি নতুন আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগেই তৃতীয় বার ফেয়ারওয়েল মানির নামে ৭৫ লাখ টাকা তুলে নেন সৈয়দ মনিরুল ইসলাম। রেজুলেশন অনুযায়ী তার এ টাকা নেয়ার কথা চূড়ান্ত বিদায়ের সময়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ স্মৃতি কলেজের পরিচালনা কমিটির নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালক সৈয়দ মনিরুল ইসলামের জন্য মাসিক সম্মানী নির্ধারণ করা হয় ৭০ হাজার টাকা। ২০১৫ সালে সরকার এ বেতন স্কেল বৃদ্ধির পর বিদ্যমান পদে তার ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেয়ার কথা। অথচ তিনি গত ডিসেম্বরে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা সম্মানীর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া নেন ১০ হাজার টাকা, গুড পারফরম্যান্স অ্যালাউন্স ২১ হাজার টাকা, শিফট ভাতা ৬৩ হাজার টাকা, বৈশাখী ভাতা ২৮ হাজার টাকা, অভোগকৃত ছুটি ৯৩ হাজার ৩৩৩ টাকা, পোশাক ভাতা ৪২ হাজার টাকা, উৎসে কর কর্তন ২৫শ’ টাকাসহ মোট ৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা তুলে নেন। সৈয়দ মনিরুল ইসলামের ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের এক হিসাবেই গত ১০ বছরে লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৮৮ হাজার ৮২০ টাকা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টাকা নিয়েছি। তবে আর নেব না। একবারই নিয়েছি।’ কোচিং না করেও ৫৩ লাখ টাকা কিভাবে নিলেন জানতে চাইলে কোনো উত্তর না দিয়েই তার মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

হিসাবছাড়া হিসাবরক্ষক : কলেজটির হিসাবরক্ষক এসএম নাজমুছ ছাকিব কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন আরও কয়েক বছর আগে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একটি হিসাবেই ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৯ হাজার ৮৩৭ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই ব্যাংকে ৬ বছরের ছেলে আহনাফ এস ড্রিম নামে অন্য একটি হিসাবে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুধু জমাই হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। আর কৃষি ব্যাংকের আরেকটি হিসাবে এক কোটি ২৯ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ আছে। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতার কোটি কোটি টাকা তহবিলে জমা না দিয়ে পকেটস্থ করেছেন। যেদিন প্রতি মাসের বেতন ব্যাংকে জমা হয়েছে, তার আগের দিন অথবা পরের দিন লাখ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ রয়েছে অসংখ্যবার। দেখা গেছে, ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ বছরে নাজমুছ ছাকিবের এ একটি অ্যাকাউন্টে শুধু নগদই জমা হয়েছে ২ কোটি ২ লাখ ৭১ হাজার টাকা।

এর বাইরে শহীদ স্মৃতি কলেজ থেকে বেতন-বোনাস বাবদ নিয়েছেন ৩৯ লাখ ৬৬ হাজার ২১৮ টাকা। শুধু তাই নয়, হিসাবরক্ষক হিসেবে তার কোনো ক্লাস নেয়ার কথা নয়। অথচ কোচিং ও অতিরিক্ত ক্লাসের নামেও তার ব্যক্তিগত এ ব্যাংক হিসাবে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৫৬৪ টাকা জমা হয়েছে। এ বিষয়ে গঠিত অডিট কমিটি ২০১৬ সালে শুধু এক বছরেই অন্তত এক কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে বলে প্রতিবেদন জমা দেয়। এছাড়া সব কিছু ছাপিয়ে নাজমুছ ছাকিবের বিরুদ্ধে ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগ প্রবল।

এদিকে হিসাবরক্ষক নাজমুছ ছাকিবের আর্থিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে চাকরিচ্যুত হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অডিট কমিটির প্রধান সন্তোষ কুমার কর্মকারসহ ৬ শিক্ষক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি স্বীকার করে সন্তোষ কুমার কর্মকার যুগান্তরকে বলেন, ‘পরিচালকসহ সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজের আয়-ব্যয় তদন্ত করি। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট এক বছরের আর্থিক হিসাব বিবরণী জমা দেয়া হয়। যেখানে দেখা যায়, এক বছরেই প্রায় এক কোটি টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি। এরপর মামলা আর ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়।’

তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী এবং হিসাব সহকারী নাজমুছ ছাকিবকে হিসাবরক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন পরিচালক। কিন্তু শিক্ষকরা ১০ বছরেও কোনো পদোন্নতি পান না। এমনকি পরিচালক মনিরুল ইসলাম হিসাবরক্ষক নাজমুছ ছাকিবকে সপ্তম গ্রেডে বেতন-ভাতাও দিচ্ছেন, যা বিধিবহির্ভূত ও রহস্যজনক।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএম নাজমুছ ছাকিব বলেন, ‘এসব অভিযোগ নিয়ে এখন কথা বলতে পারব না। আমাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। আমি এখন হাসপাতালে ভর্তি।’

টাকা লোপাটের রাজসাক্ষী : কোটি কোটি টাকা কিভাবে লোপাট হয় তার রাজসাক্ষী ফরিদ আল হাসান। তিনি এক সময় শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। ২০১৭ সাল থেকে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় স্থাপিত মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অথচ প্রকৃত তথ্য গোপন করে তাকে টানা দুই বছর মিরপুর শহীদ পুলিশ কলেজ থেকে বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে। গুরুতর এ অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরে আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী তার বেতন-ভাতা বন্ধ করেন। মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফরিদ আল হাসানকে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ থেকে বেতন-ভাতা দেয়ার বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের স্টেটমেন্ট পাওয়া যায়। এতে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফরিদ আল হাসানকে বেতন-ভাতাসহ ৮ লাখ ৫০ হাজার ১৯৫ টাকা তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে জমা দেয়া হয়েছে। ব্যাংক স্টেটমেন্টে টাকা পরিশোধের যে হিসাব পাওয়া যায় তাতে দেখা গেছে, বেতন-ভাতা ছাড়াও অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া, কোচিং বিল, শিফট ভাতাসহ ভুয়া বিল তৈরি করে তাকে পরিশোধ করা হয় ১ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৫ টাকা। তাকে বেতন-ভাতা দিতে গোপনে তার দৈনিক হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর নেয়া হয়। অথচ তিনি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকেই মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন।

এ বিষয়ে ফরিদ আল হাসানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘৪ বছর আগেই শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ থেকে আমি চলে এসেছি। তাহলে কিভাবে এখান থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেতন-ভাতা নিলেন প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘আসলে অফিসিয়ালি আমি চাকরি থেকে রিজাইন দেয়ার পর আর বেতন-ভাতা নেইনি। কবে রিজাইন দিয়েছি সেই তারিখটাও এখন আর মনে নেই।’

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, পুলিশের সাবেক একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার প্রচ্ছন্ন আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কলেজ শিক্ষক ফরিদ আল হাসান এমন অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক আইজি শহিদুল হক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি তিনি তার পিতা-মাতার নামে গড়ে তুলেছেন। পুলিশ প্রধান থাকাবস্থায় পদাধিকারবলে মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের সভাপতি ছিলেন। ওই সময় তিনি নিজ জেলা শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পারিবারিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন।

অযোগ্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ : ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান নৃবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির ১৩৩ জন শিক্ষক আইজিপির কাছে লিখিত অভিযোগ করে বলেছেন, শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে তার প্রভাষক হওয়ারও যোগ্যতা নেই। এ প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ের কোনো পাঠদান নেই। শুধু পরিচালক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম নিজের স্বার্থে আজ্ঞাবহ একজনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে রেখে যা ইচ্ছে তাই করছেন।’ এ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কোনোদিন ক্লাসে যাননি। তাকেও গত ১০ বছরে প্রায় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৩৩ টাকা কোচিং ও শিফট ভাতা দেয়া হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তিনি বেতন-ভাতা নিয়েছেন ৬৬ লাখ ৭৯ হাজার ২২৭ টাকা। আর এ বেতন জমা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ ৪৮ হাজার ৭৬৩ টাকা।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি অবৈধ কোনো সুযোগ-সুবিধা নেইনি। আমাকে যে টাকা দেয়া হয়েছে তাতে অনুমোদন আছে।’ অযোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

শিফট ইনচার্জের লেনদেন অস্বাভাবিক : শিফট ইনচার্জ কাজী বদরুজ্জামান। অথচ তিনি নিজেকে পরিচয় দেন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে। তার ব্যাংক এ্যাকাউন্টেও অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। কলেজে চাকরির বাইরে তারও কোনো আয় নেই। অথচ তার সেলারি হিসাবে গত ১০ বছরে বেতন ও অন্য সুযোগ-সুবিধার বাইরে ২৩ লাখ ১২ হাজার ৪৮৫ টাকা নগদ জমা হয়েছে। আর এই সময়ে লেনদেনের পরিমাণ এক কোটি ৫৫ লাখ ১ হাজার ৩৫৫ টাকা। এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মান্নানও কোটিপতি : তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী হিসেবে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে চাকরি পান এসএম আবদুল মান্নান। পরে তাকে সহকারী শিক্ষক ও একাডেমিক অফিসার পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ২০১০ সালেও তার বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা। সেই মান্নান পরিচালক ও হিসাবরক্ষকের অনুসারী হয়ে যেমন পদমর্যাদা বাড়িয়েছেন তেমনি আর্থিক সচ্ছলতাও বেড়েছে কয়েকগুণ। চাকরির বাইরে তার কোনো আয় নেই। অথচ তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তার এক ব্যাংক হিসাবেই নগদ জমা হয়েছে ৮৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। আর তিনি প্রতিষ্ঠানটি থেকে বেতন-ভাতা পেয়েছেন ৪৩ লাখ ৬ হাজার ৩২৬ টাকা। ১০ বছরে এ এক অ্যাকাউন্টেই লেনদেন হয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে জতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমার ও স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট। ৪৫ লাখ টাকা লোন আছে। স্ত্রীও অন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। স্ত্রীর নামের ফ্ল্যাটটি নির্মাণাধীন।’ ব্যাংকে কোটি কোটি লেনদেনের বিষয়ে বলেন, ‘ভাগনি ও ভাগ্নের ফ্ল্যাট নির্মাণের টাকা আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। আত্মীয়স্বজন মিলেও আমাকে কিছু টাকা দিয়েছেন। নাজমুছ ছাকিবের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’

সবই পেয়েছেন প্রিয়তোষ : প্রিয়তোষ চন্দ্র সরকার। পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন কনস্টেবল পদে। অবসরপ্রাপ্ত একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তার আনুকূল্যে হিসাবরক্ষক নাজমুছ ছাকিবের হাত ধরে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজে শারীরিক শিক্ষার ইন্সট্রাকটর হিসেবে ডেপুটেশনে আসেন। ডেপুটেশনে থাকাবস্থায়ই তিনি এসআই পদে পদোন্নতি পান। পোস্টিং পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি)। কলেজের ১০ হাজার শিক্ষার্থীর সারা বছরের খাতা, আইডি কার্ড, মনোগ্রাম, ক্যালেন্ডার, ডাইরি, সিলেবাস, বই, টুপি, পোশাক তৈরি করে অধিক দামে এ কলেজে সরবরাহ করতেন বলে অভিযোগ আছে। এ প্রিয়তোষকেও বেতন-ভাতা, কোচিং বিল, শিফট ভাতা বিল দেয়া হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু ২০১০ সাল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ থেকে তাকে বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে ১১ লাখ ৭ হাজার ৪৯৯ টাকা। এছাড়া কোচিং ও শিফট ভাতা দেয়া হয়েছে ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৩৮৭ টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ অ্যাকাউন্টে শুধু নগদই জমা হয়েছে ২৯ লাখ ২৯ হাজার টাকা। আর লেনদেনের পরিমাণ ৭২ লাখ ৯৫ হাজার ১৯৩ টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিয়তোষ চন্দ্র সরকার বলেন, আমার বেতন-ভাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকেই হয়। তাহলে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ থেকে কিভাবে এতগুলো টাকা নিলেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, পরিচালনা কমিটি এ টাকা দিয়েছে।’ নগদ টাকা জমা হওয়ার বিষয়ে প্রিয়তোষ সরকার বলেন, ‘পুলিশ সদস্য হিসেবে বেতনের টাকাও এ হিসাবে জমা হয়েছে।’ কিন্তু তার বেতন-ভাতার টাকা এখানে জমা হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত শহীদদের স্মৃতি রক্ষা ও তাদের স্মরণে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে এখন দশ হাজার ছাত্রছাত্রী এখানে অধ্যয়ন করছে।

যুগান্তর

Next Post

ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বরতরাই ভোট দেয়নি, এটা নির্বাচন কমিশনারের উপর তাদের অনাস্থার প্রমাণ, সুজন ।

রবি ফেব্রু. ৯ , ২০২০
আভা ডেস্কঃ ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে মানিকনগর মডেল হাই স্কুল (উত্তর পার্শ্বের টিন শেড ভবন) কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ভোট পেয়েছেন মাত্র ১৬টি। অথচ এ কেন্দ্রে সেদিন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী ৯টি সংগঠনের ২১৭ স্থানীয় নেতাকর্মী পাহারা দিয়েছেন। এ কেন্দ্রে ভোটার ২৩০৮ জন। […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links