প্রধানমন্ত্রী’কে স্মারকলিপি দিলো রাজশাহী উদীচী

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার, বাক স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পথ অবাধ করার দাবীতে রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাজশাহী জেলা সংসদ।

বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) বেলা ১১ টায় রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উদীচী রাজশাহী জেলা সংসদের সভাপতি অধ্যক্ষ জুলফিকার আহমেদ গোলাপ, সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ রাজকুমার সরকার, সাধারণ সম্পাদক অজিত কুমার মন্ডল, জাতীয় পরিষদ সদস্য শাহিনুর রহমান সোনা ও সদস্য সেলিনা বানু জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল’র হাতে এ স্মারকলিপি তুলে দেন।

স্মারকলিপিতে তার বলেন, দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিসংতার বিচার, বাক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পথ অবাধ করা, সাম্য, স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিপাগল লাখো মানুষ। অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেয় ৩০ লক্ষ শহীদ, সম্ভ্রম হারিয়ে বীরাঙ্গনা নাম নিয়েছিলেন কয়েক লাখ মা-বোন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে তৈরি হয় মহান সংবিধানের চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, সেইসব মূলনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শসমূহ নানা ষড়যন্ত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। দেশজুড়ে অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে নারকীয় সাম্প্রদায়িক তা-ব। মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ অবরুদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত। বাংলার চিরায়ত সুর আজ রুদ্ধ। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালনের কাছে সহজিয়া শিল্পীরা আজ কুণ্ঠিত। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট লেখাসমূহ পড়ে বেড়ে উঠছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। বিভিন্ন স্থানে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং এর আদর্শকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু, এ অবস্থা চলতে পারে না। তাই আমরা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট দাবি আপনার কাছে উত্থাপন করছি:

১. বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরেও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে আমরা প্রত্যক্ষ করছি সাম্প্রদায়িক হামলা। সাম্প্রদায়িক দানবদের অবাধ বিচরণ আর হুঙ্কারে প্রাণভয়ে শঙ্কিত দেশের মানুষ। ধর্মের নামে বারবার এমন নৈরাজ্যকর পরস্থিতি তৈরির অপকৌশলসমূহ প্রতিরোধে অবিলম্বে দেশজুড়ে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক তা-বের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করে তার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

২. স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় যেকোন বিষয়ে যে কারোর অধিকার রয়েছে ভিন্নমত প্রকাশের, প্রতিবাদ জানানোর। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের

ধারাকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা কালাকানুনের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিকভাবে দমন করা হচ্ছে ভিন্নমত। আমরা চাই, এ অস্বাভাবিক ধারা বন্ধ হোক। অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নিপীড়নমূলক সকল আইন বাতিল এবং এই আইনে গ্রেফতারকৃত সকলকে মুক্তি দেয়া হোক।

৩. স্বাধীনতার অন্যতম মৌল চেতনা ছিল সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠন করা। এ কাজে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতি। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউল, মুর্শিদী, মারফতিসহ মাটির সুরের লোক গান। এ ছাড়াও যাত্রাপালাসহ অন্যান্য মাধ্যমে বাংলার পথে প্রান্তরে অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছেন লালন, হাছন, শাহ আব্দুল করিমের মতো লোক সাধকরা। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ অবরুদ্ধ। জেলা উপজেলা পর্যায় তো বটেই, খোদ রাজধানীতে ও শিল্পচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তাই আমাদের দাবি, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর শিল্পকলা একাডেমি গড়ে তুলতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা আদর্শ নয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

ও মূল্যবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক বলয় ও কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

৪. নতুন প্রজন্মকে আবহমান বাংলার সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অটুট রাখতে দেশের প্রতিটি

স্কুলে শিল্পকলা বিষয়ক একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। একইসাথে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ রহিত করতে হবে। বিভেদ, বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টিকারী সব লেখা ও উপাদান পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে হবে। গণতন্ত্র, মানবমর্যাদা ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষা পাঠক্রম পুনর্বিন্যাস করতে হবে। নিয়মিত চর্চায় পাঠ্যপুস্তকে সংবিধানের মৌলিক চেতনার অংশ যুক্ত করতে হবে।

৫. সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়না। পালন করা হয়না মহান মুক্তিসংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত কোনো জাতীয় দিবস। তাই আমাদের দাবি, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা তা ধারাবাহিক নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করা।

৬. জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পুরো বিশ্ব। উন্নত দেশগুলোর একের পর এক পরিবেশ ধ্বংসকারী পদক্ষেপ আর লাগামহীন শিল্পায়নের ফলে মানব জাতির অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তবুও দেশে উন্নয়নের নামে একের পর এক প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। বন উজাড় করে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্প-কারখানা। নানা অজুহাতে প্রান্তিক ও সংখ্যায় মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর মানুষদের বসতভিটা থেকে বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। নিজ দেশেই আজ উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব মানুষ। এসব কর্মকা- মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলে আমরা মনে করি। তাই অবিলম্বে উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী সকল প্রকল্প বাতিল ও উচ্ছেদ বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি আমরা।

উপরোক্ত সবগুলো দাবিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা এবং মহান সংবিধানের চার মূলনীতির সাথে শতভাগ সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই, উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নে আপনার সক্রিয় পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

Next Post

রাজশাহীতে সক্রিয় চাঁদাবাজ চক্রের তিন সদস্য আটক

বৃহস্পতি অক্টো. ২৮ , ২০২১
আভা ডেস্কঃ রাজশাহী মহানগরীতে চাঁদাবাজীর অভিযোগে ৩ জনকে আটক করেছে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ। এসময় আসামীদের কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার হয়। গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলো রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার হোসনীগঞ্জের মোঃ গোলাম রাব্বানী সুমনের ছেলে মোঃ রাজেস (২৪), পাঠানপাড়ার মৃত আশরাফ আলী জামানের ছেলে মোঃ আতাউর রহমান বনি (৩৫) ও […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links