চাহিদামাফিক খুশি করতে না পারলে ফাইলে ধুলো জমতে শুরু করে।

ava desk : ভূমি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছে। সেবাপ্রার্থীরা তাদের আইনানুগ ন্যায়সঙ্গত আবেদন-নিবেদন নিষ্পত্তি করতেই পারছেন না। আবার শত বাধা পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও ফাইল আটকে যাচ্ছে।
চাহিদামাফিক খুশি করতে না পারলে ফাইলে ধুলো জমতে শুরু করে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান ভূমি সচিব আবদুল জলিলের নেতিবাচক অবস্থান। কোনো ফাইল উপস্থাপন হলেই তার প্রথম কাজ হল- যেনতেন উপায়ে কোয়ারি দেয়া।
এ কারণে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জনস্বার্থ কার্যক্রম একরকম স্থবির। প্রতিটি শাখায় অসংখ্য প্রস্তাব ও চিঠি আটকে আছে। তাই সরকারের নির্বাচনের বছরে এসে ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ-অসন্তোষের শেষ নেই।
এদিকে এই ঘেরাটোপ থেকে দেশের স্বনামধন্য শিল্প গ্রুপেরও রেহাই মিলছে না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও তাদের আইনসিদ্ধ ফাইল বৃত্তবন্দি হয়ে পড়ছে মহলবিশেষের ক্ষমতা অপব্যবহারের খাঁচায়। আর যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার সেখানে জেঁকে বসে দুর্নীতির রাহুগ্রাস।
যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যমুনা গ্রুপের উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দুটি প্রস্তাব। জমির শ্রেণী পরিবর্তন এবং অধিগ্রহণ বিষয়ে এ শিল্প গ্রুপের দুটি ফাইল দু’বছর ঘুরপাক খাওয়ার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পর্যায়ে আটকে আছে।
প্রয়োজনীয় সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত থাকা সাপেক্ষে প্রস্তাব দুটি এপ্রিল মাসে প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী পর্যন্ত অনুমোদন লাভ করে। এর আগে ভূমি সচিব আবদুল জলিল ইচ্ছামতো তার হয়রানি পর্বের প্রথম রাউন্ড শেষ করেন।
প্রতিমন্ত্রীর ইতিবাচক মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ফাইল ছেড়ে দেবেন বলে আজ-কাল করে টানা দেড় মাস পার করেন। রহস্যজনক অপেক্ষার পালা শেষ হলে তিনি ‘আলাপ করুন’ লিখে সচিবের কাছে ফাইল দুটি ফেরত দেন।
এরপর সচিব দ্বিতীয় দফা যমুনা গ্রুপের বিরুদ্ধে তার হয়রানি মিশন শুরু করেন, যা এখনও অব্যাহত আছে। ফাইলে বিদ্যমান থাকা কাগজপত্র পুনরায় হবিগঞ্জের ডিসির কাছে চেয়ে তিনি রীতিমতো বসে যান হয়রানি খেলার দর্শকের সারিতে।
ওদিকে ডিসির কাছ থেকে দ্রুত জবাব আসবে এবং আসামাত্রই ফাইল ছেড়ে দেবেন বলে ভূমিমন্ত্রী যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের কাছে সাত দিনের সময় নেন। কিন্তু ২৬ দিনেও ডিসির জবাব মেলেনি। মন্ত্রীর মতো হবিগঞ্জের ডিসিও আজ-কাল বলে বলে শুধু সময়ক্ষেপণই করছেন।
ডিসি মাহমুদুল কবীর মুরাদ ছাড়াও এডিসি (রাজস্ব) নুরুল ইসলামকে তিন দফায় তাগিদ দিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব। কিন্তু হালে পায়নি। কোথায় যেন রহস্যজনক বাধার শক্ত দেয়াল। যেখানে সব ষড়যন্ত্র একই সুতোয় গাঁথা।
আর ভাবখানা এমন- মন্ত্রীর ডাকে যেমন মন্ত্রণালয়ের সচিব সাড়া দেন না, তেমনি ডিসিও এখন কথা শোনেন না।
এর ফলে যমুনা গ্রুপের মতো স্বনামধন্য দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপ নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। সরকারের বিনিয়োগনীতির অন্যতম সহযোগী হিসেবে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের জন্য হবিগঞ্জে যমুনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বিশাল বিনিয়োগ করেও পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
সঙ্গত কারণে শিল্পে বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে এমন হয়রানির নজিরবিহীন ঘটনায় শুধু ক্ষুব্ধ হওয়াটাও অস্বাভাবিক। তাই এই দীর্ঘ হয়রানির বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম।
এ বিষয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তদন্তসাপেক্ষে এ ঘটনার সুবিচার দাবি করছি। অন্তত এই একটি ঘটনা নিরপেক্ষভাবে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে তদন্ত করে দেখা হোক। তাহলে দেশে বিনিয়োগের পথে কারা পেছন দরজা দিয়ে বাধা দিচ্ছেন তা প্রমাণিত হবে।’
যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভূমি মন্ত্রণালয়ে আমার নথি নিয়ে দু’বছর ধরে হয়রানির রেকর্ড সৃষ্টি করা হয়েছে। পদে পদে অন্যায়ভাবে কোয়ারি করা হয়েছে। সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু এ রকম হয়রানি ফেস করার পরও যখন মন্ত্রী পর্যায়ে নিষ্পত্তির সময়ও নথি আটকে দেয়া হল তখন হতবাক হয়েছি।
আমি মনে করি, এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন চিন্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই আমি পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাচ্ছি। তদন্তে যে বা যারাই দোষী প্রমাণিত হবে আশা রাখি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে। সেটি যদি আমিও হই, তা সশ্রদ্ধচিত্তে মেনে নেব।’
তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে আরও বলেন, ‘অন্তত একটা ঘটনা তদন্ত করে দেখুন। তাহলে প্রমাণিত হবে আপনার আশপাশে থাকা প্রভাবশালী লোকদের কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কীভাবে হেনস্তা করছেন।
এর ফলে আপনি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য রাত-দিন যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তা পর্দার আড়ালে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মন্ত্রী থেকে শুরু করে এই শ্রেণীর প্রভাবশালী মহলের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগসহ দেশের বিভিন্ন সেক্টর নানাভাবে পিছিয়ে পড়ছে।
তাই শিল্পপতি হিসেবে না হলেও সম্মুখ সমরের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কাছে সবিনয় আবেদন রাখছি- গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে হলেও একটা ঘটনার তদন্ত করুন।’
এদিকে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকা ফাইল দুটি ত্বরান্বিত করার জন্য যমুনা গ্রুপের পক্ষ থেকে সব রকম চেষ্টা-তদবির ও ইনপুট দিয়েছেন গ্রুপের পরিচালক (ভূমি) সরকারের সাবেক সচিব মো. আবদুল মালেক।
এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮১ ব্যাচের এ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে ডিসি, বিভাগীয় কমিশনার এবং সর্বশেষ সচিব পদেও দায়িত্ব পালন করেছি।
কিন্তু সাবেক একজন আমলা হিসেবে বলছি, আইনগতভাবে যমুনা গ্রুপের পক্ষ থেকে সবকিছু ঠিক থাকার পরও একেবারে নির্লজ্জভাবে পদে পদে হয়রানি করা হয়েছে। যেহেতু আমি এ বিষয়টি তদারক করেছি তাই এ ভোগান্তির অন্যতম সাক্ষীদের মধ্যে আমিও একজন।’
তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের একজন সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে আমি নিজেও বিষয়টি নিয়ে বিস্মিত ও বিব্রত। তবে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের স্বার্থে উচ্চপর্যায় থেকে এ ঘটনার তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। না হলে ভবিষ্যতে দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’
প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেন আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী। তারা যুগান্তরকে বলেন, এ মন্ত্রণালয়ে ভূমি সচিবের কাছে এখন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও অসহায়। অনেক সময় তাদের ন্যায়সঙ্গত ও আইনগত সুপারিশও তিনি আমলে নেন না।
বরং বিপরীত ভূমিকা পালন করেন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে জানা যাবে, তিনি সাধারণ মানুষের ওপর কীভাবে হয়রানির স্টিমরোলার চালাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, যমুনা গ্রুপের নথি দুটির মধ্যে একটি ছিল হবিগঞ্জে যমুনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্থাপিত তিনটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মোট ৭০ একর জমির মধ্যে ৪০ একর জমি কৃষি থেকে অকৃষি বা শিল্প-কারখানার কাজে ব্যবহারের জন্য শ্রেণী পরিবর্তন সংক্রান্ত আবেদন, অপরটি হল একই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অন্তর্ভুক্ত ১৩ একর অর্পিত সম্পত্তি অধিগ্রহণের প্রস্তাব।
দুটি প্রস্তাবই আইনসিদ্ধ এবং অহরহ অনুমোদন হয়ে আসছে। এর মধ্যে আইন অনুযায়ী জমির শ্রেণী পরিবর্তনের এখতিয়ার একেবারে জেলা প্রশাসক বা ডিসির কাজ। যথারীতি হবিগঞ্জের ডিসি প্রথম দফায় ২৬ একরের অনুমতি দিয়েও দেন।
কিন্তু মহলবিশেষের ইন্ধনে দ্বিতীয় দফায় ৪০ একর জমির শ্রেণী পরিবর্তনের আবেদন নিষ্পত্তি না করে মতামত চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। ভুক্তভোগী মহল ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পর্দার আড়ালে থাকা প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে দু’বছর ধরে ঘুরপাক খাওয়া নথি দুটি অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভূমি প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত অনুমোদন পেলেও সম্প্রতি ভূমিমন্ত্রীর টেবিলে এসে আটকে যায়। নথি নিষ্পত্তির ক্ষমতা সংক্রান্ত সচিবের একটি বেআইনি প্রস্তাব নিয়ে কৃত্রিম জটিলতা তৈরি করা হয়। প্রতিমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুমোদন কিংবা গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি না করে ১৯ এপ্রিল থেকে ভূমিমন্ত্রীর দফতরে ফাইলটি পড়ে থাকে। নিষ্পত্তি না করে এভাবে দীর্ঘদিন ফেলে রাখার কারণ জানতে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম গত ২০ জুন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের সঙ্গে তার দফতরে সাক্ষাৎ করেন।
এর আগে ফাইলটি তার টেবিলে আসার পর ২৪ এপ্রিল যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মুঠোফোনে কথাও বলেন। সে সময় তিনি জানান, দ্রুত নথি দুটি ছেড়ে দেবেন। এরও আগে নথি দুটি নিষ্পত্তির বিষয়ে এ বছরের ৩ জানুয়ারি ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে তার দফতরে আলোচনা করেন যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান।
সেখানে ভূমি সচিব মো. আবদুল জলিল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলে তার বেআইনি যুক্তি খণ্ডন করে যমুনা গ্রুপ। এ সময় ভূমি প্রতিমন্ত্রী সচিবকে নির্দেশনা দিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে শিল্প বিকাশ ও বেসরকারি বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা আরও গতিশীল ও ইতিবাচক হতে হবে।
না হলে দেশে শিল্প বিকাশ হবে না। তাই আইনের মধ্যে থেকে তিনি নথি দুটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সচিবকে অনুরোধ জানান। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। যমুনা গ্রুপকে প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত নথি তুলে আনতে আরও সাড়ে ৩ মাস অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে নানারকম হয়রানি তো আছেই।
যাহোক নথি দুটি নিষ্পত্তির সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা করতে ভূমিমন্ত্রীর দফতরে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের সঙ্গে মন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রহস্যের অনেক কিছু স্পষ্ট হয়। ফাইল বিলম্বিত হওয়ার জন্য মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ আরও একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন।
এরপর যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যানকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, সাত দিন সময় দেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডিসির কাছে একটি তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেটি আসামাত্র আমি করে দেব। যমুনা গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়, যে তথ্য ডিসির কাছে পুনরায় চাওয়া হয়েছে তা তো ওই ফাইলেই আছে। তাহলে নতুন করে কেন চাওয়া হল(?)- এ সময় এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে মন্ত্রী ভূমি সচিবকে ডেকে পাঠান। কিন্তু তিন দফায় ডাকার পরও সচিব আবদুল জলিল মন্ত্রীর দফতরে আসেননি।
মন্ত্রণালয়ের দফতরে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তিনি এরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখানোর নজির স্থাপন করেন। মূলত সচিবের কাছে প্রশ্ন ছিল- রুলস অব বিজনেস এবং এ সংক্রান্ত বিধিবিধান ও আগের নজির অনুযায়ী এ ধরনের নথি সরকার তথা মন্ত্রী পর্যায়ে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা।
কিন্তু আপনার দেয়া প্রস্তাব অনুযায়ী সেটি সরকারপ্রধান পর্যায়ে নিষ্পত্তি হবে কেন? এটি কোথায় লেখা আছে। এ ছাড়া চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে ফাইল অনুমোদন করা যায় মর্মে মতামত দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন মিসকেস নথি চেয়ে সেই ফাইল পুনরায় ডিসির কাছে কেন পাঠালেন? আসলে এসব প্রশ্নের সদুত্তর তার কাছে ছিল না।
কারণ তিনি মহলবিশেষের ইন্ধনে বিধিবহির্ভূতভাবে এ ধরনের মতামত প্রদানসহ সময়ক্ষেপণ করেন। মূলত সব রকম অপচেষ্টার পরও সচিব যখন আইনের মধ্যে থাকা যমুনা গ্রুপের প্রস্তাব দুটি বাতিল করতে পারছিলেন না, তখন প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও তা সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে অনুমোদন হতে হবে বলে অভিমত দেন।
এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। যদিও ভূমি প্রতিমন্ত্রীর কাছে নথি দুটি উপস্থাপন হওয়ার পর তিনি বিধিবিধান উল্লেখ করে সুস্পষ্ট মতামত তুলে ধরে বলেন, এটি সরকারপ্রধান নয়, সরকার তথা মন্ত্রী পর্যায়ে নিষ্পত্তি হবে। এর ফলে এ ফাইল অনুমোদনে মন্ত্রীর জন্য আর কোনো বাধা ছিল না।
কিন্তু রহস্যজনক কারণে মন্ত্রীও নানা অজুহাতে দুই মাসের বেশি সময় ফাইল ধরে রাখার পর ‘আলোচনা করুন’ লিখে সচিবের কাছে ফাইল পাঠিয়ে দেন। মিসকেসের নথি ফাইলে থাকা সত্ত্বেও সময়ক্ষেপণের জন্য ভূমি সচিব পুনরায় হবিগঞ্জের ডিসির কাছে নথি চেয়ে পাঠান।
এদিকে মন্ত্রী ডাকার পরও সচিব না আসায় মন্ত্রী কিছুটা বিব্রত হন। এর কারণ জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘ভাই এখনকার আমলারা কে কার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার সে প্রতিযোগিতায় বেশি ব্যস্ত থাকে। এ ছাড়া রক্ষাকবচ হিসেবে প্রত্যেকে শক্ত ঢাল ব্যবহার করেন।
এ কারণে আমার মতো সিনিয়র মন্ত্রীরাও অনেক সময় আমলাদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না।’ মন্ত্রী শঙ্কা প্রকাশ করে আরও জানান, ‘আপনার ফাইল দীর্ঘদিন ভূমি মন্ত্রণালয়ে ঘুরপাক খাওয়ার পেছনে এক শ্রেণীর আমলার কারসাজি থাকতে পারে। না হলে এভাবে বিলম্ব হওয়ার কথা নয়।
তবে আমার কাছে যেহেতু এসেছে আমি দেখছি কত দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়। আমাকে সাত দিন সময় দেন। এর মধ্যে ফাইল রিলিজ করে দেব। এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে সায় দিয়ে কয়েক দফায় একই কথা বলেন সেখানে উপস্থিত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (খাসজমি) শামস আল মুজাদ্দিদ এবং শাখা কর্মকর্তা উপসচিব শোয়াইব আহমাদ খান।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা মন্ত্রী তার একান্ত সচিব (উপসচিব) জাকির হোসেনকে পুরো বিষয়টি মনিটরিং করার দায়িত্ব দেন। কিন্তু বাস্তবতা হল সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রায় এক মাস পার হলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এর কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রীর একান্ত সচিব জাকির হোসেন ও যুগ্মসচিব শামস আল মুজাদ্দিদ যুগান্তরকে বলেন, ‘মন্ত্রীর রেফারেন্স দিয়ে তারা কয়েক দফায় হবিগঞ্জের ডিসি মাহমুদুল কবীর মুরাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ডিসি তাদের জানিয়েছেন, নথি পাঠাতে সময় লাগবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে যুগ্মসচিব শামস আল মুজাদ্দিদ বলেন, ‘এই নথি পাঠাতে বড়জোর দু’দিন লাগার কথা। এতদিন সময় লাগার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু কী করব বলেন, মন্ত্রীর রেফারেন্স দিয়ে কথা বলার পরও এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না।’
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি তো নির্দেশ দিয়েছি। এখন নথি না আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা তো করতে হবে। আমার কাছে ফাইল না এলে আমি আর কী করব?’
যেভাবে ঘুরেছে ফাইল : হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বেজুড়া মৌজায় অবস্থিত যমুনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো হল- যমুনা স্পিনিং মিল লিমিটেড, যমুনা টায়ারস লিমিটেড এবং হুরেইন হাইটেক ফেব্রিক্স লিমিটেড।
উল্লিখিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় ৭০ দশমিক ০০৯৯ একর জমি প্রকৃত ভূমি মালিকদের কাছ থেকে কেনা হয়। এর মধ্যে ৪০ দশমিক ০৩৪৯ একর জমি কৃষি থেকে অকৃষি বা শিল্প-কারখানায় ব্যবহারের জন্য শ্রেণী পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে হবিগঞ্জের ডিসির কাছে যমুনা গ্রুপ ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট আবেদন করে।
আইন অনুযায়ী এটি ডিসির এখতিয়ার হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন ডিসি তা অনুমোদন না দিয়ে সুপারিশসহ অনুমোদনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। অথচ যমুনা স্পিনিং মিলস ও যমুনা টায়ারস লিমিটেডের অনুকূলে ২৬ দশমিক ৪৪৫০ একর কৃষিজমির শ্রেণী পরিবর্তন করে অকৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট অনুমোদন করেন হবিগঞ্জের ডিসি।
সে ধারাবাহিকতায় আইন অনুযায়ী দ্বিতীয় আবেদনও অনুমোদন পাওয়ার কথা ছিল। ডিসির এ আইনগত এখতিয়ারের কথা ১১ আগস্ট ইস্যু করা অনুমোদনপত্রেও উল্লেখ রয়েছে। যাহোক এরপর শুরু হয় হয়রানির দীর্ঘযাত্রা।
ডিসির চিঠি মন্ত্রণালয়ে আসার পর তা প্রায় এক বছর পড়ে থাকে। ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের খাসজমি-২ শাখা থেকে কিছু তথ্য চেয়ে ডিসির কাছে চিঠি দেয়া হয়। পাঁচ মাস পর ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি সেই চিঠির জবাব দেয় ডিসি অফিস। মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজপত্র ডিসি অফিস থেকে সরবরাহ করা হয়।
প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে প্রথমে জরুরি ভিত্তিতে এসব কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার মেইলে পাঠানো হয়। কিন্তু ই-মেইলে পাঠানো নথি গ্রহণ করা হবে না বলে সময়ক্ষেপণ করা হলে পরে ডাকযোগে হার্ডকপি আনা হয়।
অপরদিকে একই শিল্পপার্কের ৭০ দশমিক ০০৯৯ একর জমির মধ্যে ১৩ দশমিক ০৬০০ একর অর্পিত সম্পত্তি আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণের জন্য যমুনা গ্রুপ ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই ভূমিমন্ত্রী বরাবর আবেদন করে। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে ডিসি বরাবর আবেদন করতে মন্ত্রণালয় থেকে ২৯ আগস্ট এক চিঠিতে যমুনা গ্রুপকে পরামর্শ দেয়া হয়।
সে আবেদন করা হলে ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর ডিসি এক চিঠিতে যমুনা গ্রুপকে প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর প্রশাসনিক অনুমোদন চেয়ে যমুনা গ্রুপ বিনিয়োগ বোর্ডে আবেদন করে।
২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি দেয়া চিঠিতে বিনিয়োগ বোর্ড হবিগঞ্জের ডিসিকে জানিয়ে দেয়, ভূমি অধিগ্রহণের কাজ বিনিয়োগ বোর্ডের নয়, এটা জেলা প্রশাসকের। এ অবস্থায় হবিগঞ্জের ডিসি অফিসে গত বছরের ২৬ এপ্রিল জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির সভা আহ্বান করা হয়।
সেখানে যমুনা গ্রুপের উল্লিখিত ভূমি অধিগ্রহণের আবেদন পর্যালোচনা করে তা অধিগ্রহণে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ওই সভার সিদ্ধান্ত সুপারিশ আকারে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ মে। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে দু’মাস পর হবিগঞ্জের ডিসিকে পহেলা আগস্ট চিঠি দিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাঠাতে বলা হয়।
এর জবাবে ডিসি অফিস থেকে ২২ নভেম্বর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সুপারিশসহ জমি অধিগ্রহণ প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়েল ১৯৯৭-এর অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নির্দেশাবলির ৬, ৭.৮ ও ৯ ধারায় এবং ২০.২নং ধারায় জনস্বার্থে কোনো বেসরকারি সম্পত্তি খাসজমি ও অর্পিত, অনাবাসী এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তি অধিগ্রহণের বিধান রয়েছে।
এরপর সব কোয়ারির জবাব নিষ্পত্তি করে ফাইলটি দুটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রী পর্যায়ে উপস্থাপন করা হলেও সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তা আটকে রাখা হয়েছে।

jugantor

Next Post

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে

মঙ্গল জুলাই ১৭ , ২০১৮
আভা ডেস্ক : কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে এ কর্মসূচির আয়োজন করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। একই দাবিতে এবং অর্থনীতি বিভাগের দুই শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links