আভা ডেস্কঃ চলতি বছরে সরকারের বিভিন্ন খাতে অর্জনের খাতায় সাফল্য যোগ হয়েছে ব্যাপক। এর মধ্যে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ মেগা প্রকল্পগুলোর কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান সরকারের ভাবমূর্তিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। প্রত্যাশিত সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
এছাড়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে। তেমনি এত অগ্রগতির পরও বেশকিছু কর্মকাণ্ড ভাবমূর্তিকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে। এর মধ্যে বছরব্যাপী ব্যাপক সমালোচিত রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশকাণ্ড।
এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে চুক্তি নিয়োগ এবং বিভিন্ন মামলা দিয়ে বিরোধী রাজনীতির প্রতি কঠোর অবস্থান সরকারকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সবশেষে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে রাজাকারের তালিকা। সবকিছু মিলে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নয়।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি শপথ নেন নতুন সংসদ সদস্যরা।
এ হিসাবে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের এবং ৭ জানুয়ারি সরকারের বর্ষপূর্তি হতে যাচ্ছে। আর এ উপলক্ষে ৭ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণে বিস্তারিত তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মেগা প্রকল্প : জনগণের বহুল প্রত্যাশিত উন্নয়ন প্রকল্পের নাম পদ্মা সেতু। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অগ্রগতি সাড়ে ১৮ শতাংশ।
এছাড়া সরকারের আলোচিত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪১ দশমিক ২১ শতাংশ, মেট্রোরেল ৩৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের ৫৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের ১৭ দশমিক ১৫ শতাংশ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পে ২৬ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং দোহাজারী-ঘুমধুম পর্যন্ত রেল সংযোগ প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ২৯ শতাংশ।
শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্পগুলোর অনুকূলে খরচ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৭ হাজার ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ৪২ হাজার ৩৮০ কোটি ১৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে।
দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান : তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত ইশতেহারে দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থানের বার্তা দেয়া হয়েছিল। ঘোষণা দেয়া হয়েছিল নির্বাচিত হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের (শূন্য সহনীয়) নীতি গ্রহণ করা হবে।
কিন্তু শুরুতে তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকলেও বছরের শেষদিকে ব্যাপক আলোচিত ছিল সরকারের দুর্নীতি ও ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান। এই অভিযানে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
এছাড়া যুবলীগের চেয়ারম্যানকে দল থেকে বহিষ্কার করাসহ শীর্ষ নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। পাশাপাশি অভিযানে ৬ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। হিসাব তলব করা হয়েছে আরও কয়েকশ’ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের।
সড়ক পরিবহন আইন : দুই বছর আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল একটি যুগোপযোগী সড়ক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। এরপর পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনসহ নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আইনটি সংসদে পাস হলেও বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছিল।
আর শেষ পর্যন্ত সব বাধা অতিক্রম করে ২০১৯ সালে আইনটি বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। নতুন আইনে শ্রমিকদের জরিমানা ও সাজার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তবে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মাঠে নেমেছিল পরিবহন শ্রমিকরা। শেষ পর্যন্ত আইনটি আবারও সংশোধন হচ্ছে।
সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটের নির্দেশনা : দেশের শিল্প খাতে সহজে পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অঙ্কে) নামিয়ে আনা। গত বছর এ ব্যাপারে ব্যাংক মালিকরা সরকারকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল।
কিন্তু তারা কথা রাখেননি। ফলে দেশের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ অব্যাহতভাবে কমেছে। তবে শেষ পর্যন্ত সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বালিশকাণ্ড : তবে অগ্রগতির পাশাপাশি নেতিবাচক সংবাদও কম নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কেনাকাটায় যে দুর্নীতি হয়েছে, তা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড। ওই প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে।
নিয়ম অনুসারে ৩০ কোটি টাকার নিচে কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে না। এই সুযোগ নিয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজ ৬টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। সেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা।
আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। একইভাবে বিদেশি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকায়।
পাঁচটি ২০ তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাক ভাড়া দেখানো হয়েছে।
আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাকমতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ : গত বছর জনপ্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানোর পরও বিভিন্ন পদে ধাপে ধাপে চুক্তিতে নিয়োগ হয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসনে বেশ অসন্তোষ রয়েছে।
অনেক দিন থেকেই প্রশাসনে চলছে চুক্তির হিড়িক। অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এমনকি যেসব কর্মকর্তার যোগ্যতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে তারাও নানা পথে চুক্তিতে পুনঃনিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। এই তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও রয়েছেন। সব মিলিয়ে ২ শতাধিক কর্মকর্তাকে এভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বিরোধী রাজনীতির প্রতি কঠোর অবস্থান : গত এক বছরে সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম ছিল বিরোধী রাজনীতির প্রতি কঠোর অবস্থান। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন সময়ে রাজপথে নামতে চেয়েছিল বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠন। কিন্তু তাদের মাঠে নামতেই দেয়া হয়নি। বামদলের ওপর হামলা ও বিভিন্ন মামলা দিয়ে বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।
রাজাকারের তালিকা নিয়ে বিতর্ক : বছর শেষে ব্যাপক সমালোচিত ছিল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের রাজাকারের তালিকা প্রকাশ। বিজয় দিবসের আগে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
এই তালিকায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এবং রণাঙ্গনের অনেক আলোচিত মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। বিষয়টি ব্যাপক বিতর্কের মুখে শেষ পর্যন্ত তালিকা স্থগিত করা হয়েছে।
যুগান্তর