নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দুর্নীতির নামে হরিলুট হচ্ছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে, মেডিক্যাল দপ্তর । বাজারে এক কেজি ব্লিচিং পাউডারের দাম কত? বড় জোর ১১০-১৫০ টাকা। আর এক কেজি ভিম পাউডারের দাম কত? বড় জোর ১৫০-২০০ টাকা। আবার এক বছর ধরে কেনাই হয়নি ভিম পাউডার। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সৈয়দপুর স্টোরেও নেই এই পাউডার। তাতে কি, খরচ তো দেখাতে হবে ভিম পাউডার কেনার নামে। তবে কিছু পরিমাণে কেনা হয়েছে ব্লিচিং পাউডার। সেটির পরিমাণও হয়তো সাকূল্যে গিয়ে দাঁড়াবে ২০-৩০ লাখ টাকার। কারণ এক কেজি ব্লিচিং পাউডারের সর্ব সাকূল্যে মূল্য আর পশ্চিমাঞ্চলের হাতে গোনা যে কয়টি স্টেশনে মাঝে মধ্যে এই পাউডার ছেটানো হয়, তাতে ২০-৩০ লাখ টাকার ব্লিচিং পাউডারই যথেষ্ট রেলওয়ে কর্মকর্তাদের নিকট। তাই বাড়তি ঝুঁকি নেন না তারা। বছরে নামেমাত্র কিছু ব্লিচিং পাউডার কিনে সিংহভাগ টাকা করেন হরিলুট। আর এই হরিলুটের প্রমাণ না রাখতে ফাইলপত্রও গায়েব করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই হরিলুটের নায়ক পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মেডিক্যাল চিফ শাহনেওয়াজ। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে খোদ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই হরিলুটের পরিমাণ এতটাই বেশি যে বাজেট অতিক্রম করেছে বছরের শুরুতেই। বছরে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৮ কোটি টাকার কাছে। হ্যাঁ আশ্চর্য হলেও সত্য। শুধুমাত্র স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে বছরে অন্তত ৮ কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে ব্লিচিং ও ভিম পাউডারের পেছনে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সহ নিম্ন শ্রেনীর কর্মচারী পযন্ত। এক কথায় দশ’জনে মিলে এই টাকা লোপাট করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের মাঝে। বিষয়টি তদন্ত করে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। কিন্ত কে করবে তদন্ত, আর কে বা নিবে হিসাব এই দপ্তরটি ঘীরে নানা অনিয়মের প্রমান্যচিত্র তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ হলেও নানা ছল চাতুরীর মাধ্যমে সময় ক্ষেপন করেন খোদ জিএম শহিদুল ইসলাম পশ্চিম। লুটপাটের ভাগ যখন সবাই পায় তখন কে শুনবে কার কাহিনী, ধামাচাপা দিতেই ব্যতিব্যস্ত থাকেন তারা।
রেলওয়ে সূত্র মতে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের আওতায় সর্বমোট ২৩১টি স্টেশন আছে। এর মধ্যে ৯২টি বন্ধ হয়ে গেছে। আর ৫৮টি ক্ষয়িষ্ণু। এসব স্টেশনে কর্মকর্তাই তেমন নাই। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন এখনো রয়েছে প্রায় ৫০টির মতো। এই ৫০টির মধ্যে ১০টি স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা করা হয় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার আওতায়। বাকি ৪০টি স্টেশন রয়েছে প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণাধিন ট্রাফিকের আওতায়। এসব স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে বছরের পর বছর ধরে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে গত দুই বছর ধরে। এই দুই বছরের মধ্যে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এএসএম এমতেয়াজের দপ্তরের মাধ্যমে কোনো ভিম লিকিউড বা পাউডার কেনাই হয়নি। অল্প পরিমাণে কেনা হয়েছে ব্লিচিং পাউডার। সেগুলোও নিম্মমাণের।
পাউডারের ড্রামের নিচে পানি জমে গেছে নিম্নমাণের কারণে। কিন্তু এই দপ্তরের আওতায় প্রতি অর্থ বছরে অন্তত ৮ কোটি টাকার ব্লিচিং ও ভিম পাউডার কেনা হয়েছে কাগজে-কলমে। এই টাকা খরচ দেখিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাত করে অধিকাংশ টাকায় হরিলুট করা হয়েছে। ফলে স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার তেমন কোনো কাজেই আসছে না। এতে করে পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ স্টেশনেই ময়লা-আর্বজনার যেনো ভাগাড়ে পরিণত হয়ে থাকে সবসময়।
অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তার ট্রাফিক বিভাগের আওতায় বাকি ৪০টি স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা করা হলেও কেনাকাটা করা হয় প্রধান সরাঞ্জম কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন সরকারের মাধ্যমে। কেনাকাটা যেই করুক চুরি করা টাকার ভাগ নিতে কেউ পিছু পা হয় না। পিয়ন থেকে চাপরাশি সকলেই এই লুটের টাকার ভাগ পায়। বিধায় একজন অন্যজনের ধারে দোষ চাপিয়ে বাঁচতে চায়, তাই চিফ মেডিক্যাল অফিসার দোষ সব সরাঞ্জাম দপ্তর প্রধানের ঘারে চাপান। কোথাও কোন ব্লিচিং পাউডার না পাওয়া গেলেও খাতা কলমের হিসাবে বছরে ৬-৮ কোটি টাকার পাউডার ক্রয় দেখায় রেল মেডিক্যাল ও সরাঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তর।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র মতে, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এসএএম এমতেয়াজ গত দুই বছরের মধ্যে সবমিলিয়ে ৬০ দিনও অফিস করেননি। অধিকাংশ সময় মাসের শেষের দুই-একদিন অফিস করেন বেতন উত্তোলনের জন্য। আর বাকিটা সময় তিনি কাটান চট্টগ্রামে তাঁর ব্যক্তিগত ক্লিনিকে। মাসে এক দুইদিন অফিস করলেও তার সারা সময় কাটে রেষ্ট হাউজে।
এই কর্মকর্তা গত দুই বছর ধরে প্রায় ৫ কোটি কোটি টাকার ব্লিচিং ও ভিম পাউডার কিনে সেই ফাইলপত্র এখন আর অফিসে রাখেননি। সব ফাইল তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কবজায় রেখেছেন গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার ভয়ে।
তাঁর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গত এক বছর ধরে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার আওতায় ১০টি স্টেশনের জন্য এক কেজিও ভিম পাউডার বা লিকিউইড কেনা হয়নি। কিন্তু সেটি কেনার নামেও কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আর বছর খানেক আগে অল্প পরিমাণ কিছু ব্লিচিং পাউডার কেনা হলেও সেটির মাণও একেবারে নিম্নমাণের। এই পাউডারের ড্রামের তলানিতে জমে পড়েছে পানি। কিন্তু বাধ্য হয়ে সেই পাউডার দিয়েই কোনো মতে রাজশাহীসহ অন্য স্টেশনগুলো মাঝে মাঝে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা করা হয়। এতে করে একমাত্র রাজশাহী স্টেশনটি কিছুটা পরিস্কার থাকলেও অন্য স্টেশনগুলোতে যেনো ধাপ ফেলানো যায় না ময়লার কারণে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মধ্যে রাজশাহী স্টেশনটিতে কর্মকর্তাদের আনা-গোনা বেশি থাকে বলে এই স্টেশনটি একটু পরিস্কার রাখার চেষ্টা চালানো হয় শুধুমাত্র ব্লিচিং পাউডার দিয়ে। আর অন্যসব স্টেশনে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার যেন বালাই নাই।’
জানতে চাইলে রাজশাহী স্টেশনের স্যানেটারি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ভিম পাউডার পাই না। তবে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে স্টেশন পরিস্কার রাখা হয়। আমরা যেভাবে স্টেশন পরিস্কার রাখি, অন্যগুলো হয়তো পাওয়া যাবে না।’
তিনি আরো জানান, রাজশাহী স্টেশনে বড় জোর প্রতিদিন ৫ কেজি ব্লিজিং পাউডার ব্যবহার হয়। তবে মন্ত্রীরা আসলে একটু বেশি লাগে কখনো কখনো।
এদিকে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাজশাহী স্টেশনে প্রতি দিন গড়ে ৫ কেজি ব্লিচিং পাউডার প্রতিদিন ব্যবহার হলেও মাসে প্রয়োজন পড়ে বড় জোর ১৫০ কেজি। সেই হিসেবে ১৫০ কেজি ব্লিচিং পাউডারের দাম পড়ে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা। আর এক বছরে ব্যয় গিয়ে দাঁড়ায় বড় জোর তিন লাখ টাকা। কিন্তু এই স্টেশনের পেছনেই ব্লিচিং পাউডার বাবদ খরচ দেখানো হয় অন্তত এক কোটি টাকা। পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রাজশাহী সবচেয়ে বড় স্টেশন হলেও অন্যগুলো তুলনায় ছোট। ফলে কোনো কোনো স্টেশনে মাসে একবারো হয়তো ব্লিচিং বা ভিম পাউডার ব্যবহার হয় না। কিন্তু এভাবেই প্রতিটি স্টেশন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে চলছে বছরে অন্তত ৮ কোটি টাকা লোপাটের মহোৎসব।
তবে ব্লিচিং ও ভিম পাউডার কেনার নামে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান সরাঞ্জম কর্মকর্তা বেলাল উদ্দিন সরকার। তার মতে সকল নিয়ম মেনেই এই টাকা খরচ হয়েছে।
আর প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ বলেন, কেনাকাটার দায়িত্ব আমাদের নয়, এটি দেখে সরাঞ্জম শাখা। তারাই ভালো বলতে পারবেন, কত টাকা ব্যয় হয় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নামে।
এদিকে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এসএএম এমতেয়াজের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ঈদের পরে গত কয়েকদিন ধরে তাঁর কার্যালয়ে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। একাধিক সময়ে একাধিক পত্রিকার তার সংবাদ প্রকাশ হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি পশ্চিম রেল কর্মকর্তা বৃন্দ। এতে বোঝাই যায়, প্রতিটি অনিয়মে টপ টু আপ সকলেই জড়িত তাই কেউ কারও বিষয়ে কথা বলতে চায় না। চুরি পরিমান বর্তমান জিএম শহিদুল ইসলামের আমলেই বেশি হচ্ছে বলে রেল সুত্র জানায়।
যোগাযোগ করতে চাইলেও, সরকারী মোবাইলে ফোন দিলেও কথা বলতে নারাজ বলেই প্রতিটি কল কেটে দিয়ে ম্যাসেন্স পাঠানোর জন্য বলা হয় কলারকে। কলার যখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে স্বাক্ষাৎকার চায়, তখন নানা অজুহাতে কালক্ষেপন করে এড়িয়ে যায় খোদ জিএম সহ প্রায় সকল বিভাগের প্রধানরা।
এসবি/ইপি