নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহীতে মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে চেতনতায় জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ব্যতিক্রমী কার্যকম পরিচালনা করছে মহানগর পুলিশ। ‘মুক্তিযদ্ধের গল্প শোনো’ শীর্ষক এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়েছে। পর্যাক্রমে আরো অন্তত ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে এই শপথবাক্য পাঠ করানো হবে। সর্বশেষ রাজশাহী নগরীর রিভারভিউ স্কুলে এই অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়।
মহানগরীর প্রতিটি স্কুলে প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে আরএমপি পুলিশ। পুলিশ কমিশনার মোঃ মাহাবুবর রহমান পিপিএম এর পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে এ কার্যক্রমটি চালু হয়।
অনুষ্ঠান উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধে গল্প শোনাতে স্কুলগুলোতে হাজির হচ্ছেন দুজন করে মুক্তিযোদ্ধ। তাঁদের শিক্ষার্থীরা ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে। এরপর সমবেত কণ্ঠে শিক্ষার্থীরা গেয়ে উঠছে জাতীয় সঙ্গীত। এরপর মুক্তিযোদ্ধরা একাত্তরে সেই রণাঙ্গণের নিজের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছেন। রিভারভিউ স্কুলে মুক্তিযুদ্ধে গল্প শোনাতে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল এবং মোঃ রবিউল ইসলাম। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের গল্প বলছেন আর অধীর আগ্রহে কানপেতে শুনছিলেন হাজার খানেক শিক্ষার্থী।
মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন রাজশাহী পুলিশ এর অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে রোমন্থন করেন। তৎকালীন ডিআইজি মামুন মাহমুদ, এসপি শাহ আব্দুল মজিদ সহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ সদস্যের আত্মত্যাগের কথাও গৌরবের সাথে তুলে ধরেন।
পাশাপাশি আরএমপি পুলিশের পক্ষ থেকে ‘৭১ এর ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ সদস্যরা তাঁদের থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ছোঁরা বুলেট দিয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, সেই গল্প এবং ডকুমেন্টরি চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টরি প্রদর্শন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাচ, গান, কবিতা, আবৃত্তি, ডিসপ্লে ও কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের স্মৃতির বিভিন্ন আলামতও তুলে ধরছেন। থাকছে উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব ও মুক্তিযুদ্ধের ধারণা নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষদিকে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ করানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি বাল্যবিবাহমুক্ত ও ইভটিজিংমুক্ত দেশ গড়ার শপথবাক্যও পাঠ করানো হচ্ছে।
এই ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া নগরীর রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমাইয়া জানায়, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে শুনতে পেরে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি। মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল, আমরা কিভাবে স্বাধীনতা পেলাম এসব ধারণা আমরা পেয়েছি।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলী হাবিব জানায়, আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছি, ইতিহাস শুনেছি, তবে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাঁদের মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে আমাদের অনেক ভালো লাগছে।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবু জাফর বলে, সব কিছুই ভালো লেগেছে, তবে মুক্তিযুদ্ধের কুইজ প্রতিযোগিতাটি আমরা খুব এঞ্জয় করেছি। এ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আরএমপি’র পুলিশ কমিশনারকে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখার উপপুলিশ কমিশনার আবু আহম্মদ আল মামুন বলেন, ‘যারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের মুখ থেকেই শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনছে- এটা তাদের জন্য বড় পাওয়া। আজ বেশির ভাগ বীর মুক্তিযোদ্ধা বার্ধক্যে উপনীত। অনেকে দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছেন- কিছুদিন পর আমরা জাতির এ সূর্য সন্তানদের আর দেখতে পাব না, তাঁদের মুখ থেকে গল্প শুনতে পাবো না। তাই এ কার্যক্রমের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করছি আমরা পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও জানছে মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত ইতিহাস।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের শপথ করি, স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ি- এমন স্লোগানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ, মাদক ও জঙ্গিবাদ এর বিরুদ্ধে সচেতনতার প্রত্যয় ও শপথ করানো হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ধারনায় ও চেতনায় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে মহানগরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রমটি চালানো হবে। সেই হিসেবে অন্তত ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে মুক্তিযুদ্ধে গল্প শোনানোর পাশাপাশি জঙ্গিবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ করানো হবে।
এরইমধ্যে রাজশাহী বহুমুখী বালিকা বিদ্যালয়, হেতেম খাঁ, রাজশাহী সরকারী বালিকা বিদ্যালয়, হেলেনাবাদ, রাজশাহী গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি উচ্চ বিদ্যালয়, মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী, রাজশাহী সরকারী মাদ্রাসা উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ নজমুল হক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, খাদেমুল ইসলাম স্কুল এন্ড কলেজ, শিরোইল সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, কাশিয়াডাঙ্গা হাইস্কুল, হামিদপুর নাওদাপারা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও রিভারভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নগরীর রিভারভিউ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোয়ারা পারভীন বলেন, ‘এটি সত্যিই একটি ভালো উদ্যোগ। আজকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শিক্ষার্থীরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকেই শুনছে। পাশাপাশি তারা জঙ্গিবাদমুক্ত, বাল্যবিবাহমুক্ত এবং ইভটিজিংমুক্ত দেশ গড়ার শপথ নিচ্ছে। এটি তাদের মাঝে চেতনা সৃষ্টি করছে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিতে পারলে অবশ্যই একদিন জঙ্গিবাদমুক্ত সোনার বাংলা দেখতে পাবো আমরা।’
এ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল বলেন, ‘আমরা একদিন থাকবো না। তখন আজকের এই গল্প শিক্ষার্থীদের মাঝে থেকে যাবে। কিন্তু আমরা যদি এই গল্প বলার সুযোগ না পেতাম, তাহলে শিক্ষার্থীরাও রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়তো জানতই না। মুক্তিযুদ্ধে এই গল্প শুনে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণীত হচ্ছে। আশা করি তারা মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে আগামীতে একটি জঙ্গিবাদমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলবে।’