আভা ডেস্ক : সময়মতো এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ করতে না পারায় উদ্বেগ জানিয়ে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিকে চিঠি দিয়েছে সরকার। চিঠিতে দ্রুততার সঙ্গে আমদানি করা এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের তাগিদ দেয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে গত সপ্তাহে এ চিঠি দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) ও টার্মিনাল থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণ করে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহের কার্যাদেশ পাওয়ার পর এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে সরকারের চুক্তিও হয়।
কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে তারা পাইপলাইনে ত্রুটিসহ নানা কারণ দেখেয়ে সময়ক্ষেপণ করছে। খুঁড়িরে খুঁড়িয়ে করছে পাইপলাইন সংযোগের কাজও। ফলে গত আড়াই মাসেও এলএনজি যুক্ত করা সম্ভব হয়নি জাতীয় গ্রিডে।
এতে একদিকে বিপাকে পড়েছে সরকার, অপরদিকে গ্যাস না পেয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে হাজার হাজার শিল্প-কারখানা। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- এতকিছুর পরও আইনের মারপ্যাঁচের ফাঁদে এক্সিলারেট এনার্জির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না সরকার।
জানা গেছে, এলএনজি না আসায় সাড়ে ৩ হাজারের বেশি শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দিয়েও গ্যাস দিতে পারছে না সরকার। মে মাস থেকে এসব কারখানায় গ্যাস দেয়ার কথা ছিল। সব ধরনের অবকাঠামো তৈরি করেও গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছেন না শিল্পমালিকরা।
হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এখন তাদের মাথায় হাত। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে শিল্প খাতে এ রকম বিপর্যয় আগে দেখা যায়নি। সাগরে স্রোতের অজুহাত দেখিয়ে গত আড়াই মাসেও সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে ভাসমান টার্মিনালের সংযোগ করতে না পারা রহস্যজনক। তাদের অভিযোগ এজন্য দায়ী মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে তারা সময়ক্ষেপণ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর চেয়ে বেশি স্রোতের মধ্যেও ডুবুরিরা বড় বড় পাইপলাইনে কাজ করছেন।
কিন্তু রহস্যজনক কারণে মহেশখালীতে সাগরের তলদেশে তারা কোনো কাজই করতে পারছে না। সর্বশেষ তথ্য- এখন পর্যন্ত মূল পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি ভাসমান টার্মিনালকে। ফলে আগামী মাসেও জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, বহুল প্রত্যাশিত এলএনজি নিয়ে শুরুতে এ রকম অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় এক ধরনের আস্থাহীনতার পরিবেশ ঘনীভূত হচ্ছে। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখবর নয়।
শিল্পমালিকদের অভিযোগ, এলএনজি সরবরাহে এই দেরির নেপথ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। একই সঙ্গে ভোটের আগে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার ষড়যন্ত্রও হতে পারে এই দেরি। শিল্পমালিকদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরির কূটকৌশলের অংশও হতে পারে এলএনজি নিয়ে সময়ক্ষেপণ।
বলা হচ্ছে, বছরে ১৬টি জাহাজ যুক্ত হওয়ার কথা টার্মিনালের সঙ্গে। কিন্তু আড়াই মাসেও প্রথম কিস্তির এলএনজি বহনকারী জাহাজটি যুক্ত হতে পারল না মূল পাইপলাইনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে এলএনজি সরবরাহ শুরু হলে একদিকে সাগরে যেমন জাহাজজটের সৃষ্টি হবে, অপরদিকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। বিষয়টি মাথায় রেখে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে ভাসমান টার্মিনালটি পড়ে থাকায় প্রতিদিনই উড়ে যাচ্ছে অর্ধকোটি টাকার গ্যাস। একই সঙ্গে পরিচালন বাবদও আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। কিছুদিন আগে সংসদে বাজেট আলোচনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আশ্বাস দিয়েছিলেন, চলতি (জুলাই) মাসে পাইপলাইনে এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে।
কিন্তু গত সপ্তাহে তিনি ওই বক্তব্য পরিবর্তন করে সাংবাদিকদের বলেছেন, আগস্টের শেষদিকে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আগস্টের শেষেও জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর নেপথ্যে পাইপলাইন সংযোগ কিংবা ত্র“টি নয়, আরও বড় ধরনের কারণ থাকতে পারে।
প্রসঙ্গত, এলএনজির প্রথম কিস্তি নিয়ে ২৪ এপ্রিল কক্সবাজারের মহেশখালীতে পৌঁছায় কমিশনিং কার্গো। ১২ মে পাইপলাইনে এ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের কথা ছিল।
কিন্তু এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) থেকে জাতীয় গ্রিডের আগ পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার পাইপলাইনের বিভিন্ন অংশে ছিদ্র দেখা দেয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এরপর পুনরায় সরবরাহের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৬ মে। পরে জানানো হয়, ৪ জুলাই।
কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় ৮৭ দিন ধরে সাগরে নোঙর করে বসে আছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ ঘনমিটার (৬০ হাজার ৪৭ টন) এলএনজিবাহী জাহাজটি। বিশাল এ জাহাজের পরিচালন ব্যয় (ফিক্সড অপারেটিং কস্ট) ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ দৈনিক লোকসান গুনতে হচ্ছে ৫০ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী এক্সিলারেট এনার্জি টার্মিনাল নির্মাণ ব্যয় বহন করলেও অপচয়ের ব্যয় বহন করতে বাধ্য নয়।
নির্মাণ ও ব্যবহার চুক্তি অনুযায়ী ভাসমান টার্মিনাল (এফএসআরইউ) ও টার্মিনাল থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের ব্যয় মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির। কিন্তু গ্যাসের অপচয় ও নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করতে না পারার কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তা আমদানিকারক হিসেবে পেট্রোবাংলাকেই বহন করতে হবে।
তবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ এর আগে সাংবাদিককে বলেছেন, কার্গো অপেক্ষায় রাখার জন্য সরকারের কোনো আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না। এই দায়িত্ব সরকারের নয়। এটা এক্সিলারেট এনার্জিই বহন করছে। পাইপলাইনের যে জটিলতা ছিল তা সমাধান হয়েছে। আপাতত কোনো সমস্যা নেই। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাকি আছে। ওগুলো শেষে গ্যাস সংযোগ দেয়া যাবে।
পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কমিশনিং কার্গো বসিয়ে রাখার কারণে বয়েল অব গ্যাস ও পরিচালন ব্যয় বাবদ সংস্থাটির দৈনিক প্রায় অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া কমিশনিং কার্গোর পর ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী যেসব জাহাজ আসার কথা, সেগুলো না আসার কারণেও গ্যাস ব্যবহার ছাড়াই ব্যয় বহন করতে হবে। এতে করে পেট্রোবাংলার আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়বে।
যুগান্তর