সুষ্ঠু তদন্ত করলে কয়লা চুরির আরও ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

ava desk : দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা গায়েবের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, চুরির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। স্থানীয় ঠিকাদার, কয়লা ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী এ দাবি করেছেন। তাদের দাবি- সুষ্ঠু তদন্ত করলে কয়লা চুরির আরও ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

এদিকে কয়লা কেলেঙ্কারির ঘটনায় খনির ১৯ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পার্বতীপুর থানায় করা মামলার নথি হাতে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সংস্থার দিনাজপুর জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বেনজীর আহম্মেদ জানান, বুধবার রাতে মামলার নথিটি পার্বতীপুর মডেল থানা থেকে পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার তা দুদকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হবেন। তিনি আরও জানান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পর পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে।

মামলার বাদী তার অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে চুরি ঘাপলা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ টন কয়লা। দুদকের কর্মকর্তারাও বলছেন একই কথা। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা বলছেন, কয়লা দুর্নীতির পরিমাণ অভিযোগের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যবসায়ীদের দাবি- খতিয়ে দেখলে অনেক দুর্নীতিই ধরা পড়বে। একই সঙ্গে কয়লা খনিতে ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) বাণিজ্যের সঙ্গে গুটি কয়েকজনই দায়ী বলে জানিয়েছেন তারা।

খনির সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমেদসহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এ মামলার বাদী কয়লা খনির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনিছুর রহমান মামলার অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, খনি উন্নয়নের সময় (২০০১) থেকে ১৯ জুলাই ২০১৮ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২ দশমিক ৩৩ টন কয়লা উৎপাদন হয়েছে।

উৎপাদিত কয়লা থেকে পাশের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৯ দশমিক ২৯ টন কয়লা সরবরাহ, বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে ডিও’র মাধ্যমে ৩৩ লাখ ১৯ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৭ টন কয়লা বিক্রি ও কয়লা খনির বয়লারে ১২ হাজার ৮৮ দশমিক ২৭ টন কয়লা ব্যবহার করা হয়েছে। কয়লার উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হিসাব করলে ১৯ জুলাই কোল ইয়ার্ডে রেকর্ডভিত্তিক কয়লার মজুদ দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ টন কয়লা।

কিন্তু বাস্তবে মজুদ ছিল মাত্র ৩ হাজার টন কয়লা। অর্থাৎ ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৪ দশমিক ৪০ টন ঘাটতি রয়েছে যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৩০ কোটি টাকা। ২৩ জুলাই সোমবার বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকা পরিদর্শন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দিনাজপুর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বেনজীর আহম্মেদও জানান, কাগজে-কলমে রয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার টন অথচ বাস্তবে রয়েছে ২ হাজার টন কয়লা। যাতে করে প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস নেই।

কয়লা খনিতে বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, গেটে আগের মতোই নিরাপত্তা প্রহরীরা দাঁড়িয়ে। প্রবেশের অনুমতি নেই। তবে উৎসুক অনেকেই এগিয়ে আসেন। এরই মধ্যে একজন স্থানীয় অধিবাসী রফিকুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন- খনিতে কয়লা চুরি নতুন নয় বা একদিনে হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরেই এ কয়লা চুরি করে আসছেন কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে খনির একজন মহাব্যবস্থাপক। তিনিই মূলত নাটের গুরু। দীর্ঘদিন ধরে চাকরির সুবাধে তিনি বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে আঁতাত করে দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তুলেছেন। বেশিরভাগ সময় অবস্থান করেন ঢাকায়ই। পেট্রোবাংলায়ই তার ব্যাপক প্রভাব ও প্রতাপ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, ২০১৭ সালে খনি থেকে ৩০০ টন কয়লা চুরি হয়েছিল। পরে বিষয়টি ফাঁস হলে খনির কর্মকর্তারা রাতারাতি সেই ৩শ’ টন কয়লার টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে সমন্বয় করেন। কয়লা খনি থেকে প্রতিবছরই ইটভাটা মালিকদের কাছে ১০০ টন করে কয়লা বিক্রি করা হয়। কিন্তু এ বিক্রিতেও দুর্নীতি করা হয়। কাউকে হাজার হাজার টন কয়লা দেয়া হয়েছে। আবার কারও ভাগ্যে জোটেনি এক ছটাক কয়লাও। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এটি হয়েছে বলে দাবি তার।

ভুগর্ভস্থ কয়লা খনি থেকে অনবরত পাম্পের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করা হয়। এই পানি এসে জমা হয় কয়লা খনির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে। সেখানে কয়লার ডাস্ট (ক্ষুদ্রাকৃতি কয়লা) জমা হয়। এ কয়লা পুনরায় শুকিয়ে আবার জমা করা হয় কোল ইয়ার্ডে। কিন্তু যে পরিমাণ ডাস্ট কয়লা কোল ইয়ার্ডে জমা হয় তার কোনো হিসাব রাখা হয় না। এ কয়লা অবৈধভাবে বিক্রি করে দেয়া হয়।

কয়লা ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে যে কয়লা জমা হয় তা ঠিকাদারের মাধ্যমে শুকিয়ে কোল ইয়ার্ডে জমা করা হয়। এ প্লান্ট থেকে বছরে প্রায় ১৬ থেকে ২০ হাজার টন কয়লা উৎপাদন করা হয়। কিন্তু এ হিসাব কাগজে-কলমে রাখা হয় না। কোল ইয়ার্ড থেকে অবৈধভাবে এসব কয়লা বিক্রি করেন কর্মকর্তারা। তিনি জানান, বর্তমানে অভিযোগ করা হচ্ছে কয়লা চুরি হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার টন।

কিন্তু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে জমা হওয়া কয়লার হিসাব করলে দেখা যাবে এ কয়লা চুরির পরিমাণ অনেক বেশি। একই কথা জানান, কয়লা খনির ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে জমা হওয়া কয়লা শুকিয়ে সরবরাহ করা সাবেক ঠিকাদার মিজানুর রহমান। তিনি জানান, গত প্রায় ৭-৮ বছর ধরে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে কয়লা জমা করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে জমাকৃত ডাস্ট কয়লার পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ টন হবে। এ হিসাব উধাও হওয়া ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লার বাইরে।

বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টির ফুলবাড়ী উপজেলা শাখার সম্পাদক এসএম নুরুজ্জামান বলেন, কয়লা খনিতে যে দুর্নীতি হয়েছে তার প্রধান ও অন্যতম কারণ ডিও (ডিমান্ড অর্ডার) বাণিজ্য। এ বাণিজ্যের সঙ্গে মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মকর্তারা জড়িত। তারা বিভিন্নজনের নামে কয়লার ডিও’র জন্য সুপারিশ দেন। ডিওতে কয়লার যা উল্লেখ থাকে কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ও কমিশন বাণিজ্যের জন্য তার পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায়। কমিশন বাণিজ্যের অর্থ সবার মাঝেই বণ্টন হয়।

কয়লা ব্যবসায়ী মশিউর রহমান বুলবুল বলেন, কয়লা খনির দুর্নীতি হয় কাগজে-কলমের মারপ্যাঁচে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে কিছু গ্রাহক কাগজে যা রয়েছে তার চেয়ে বেশি কয়লা গ্রহণ করেন। এতে করে কাগজে-কলমে ঠিক থাকলেও বাস্তবে কয়লা ঠিক থাকে না। যার কারণেই বর্তমানে কাগজে কয়লা থাকলেও বাস্তবে কয়লা নেই। অধিকতর তদন্ত হলে অনেক দুর্নীতিই বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন তিনি। jugantor

Next Post

বড়পুকুরিয়া কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড়

শুক্র জুলাই ২৭ , ২০১৮
আভা ডেস্ক : বড়পুকুরিয়া কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার পেট্রোবাংলার পরিচালকের (অপারেশন) নেতৃত্বে যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি এরপর হস্তান্তর করা হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কাছে। এরপর প্রতিমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links