আভা ডেস্ক ; বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আত্মহননকারী নারীদের বয়স ১৪ থেকে ৩০-এর মধ্যে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যৌতুকের কারণে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, পারিবারিক সহিংসতা, নারী হওয়ার কারণে অবদমিত করে রাখার সামাজিক মানসিকতা এবং অতিরিক্ত চাপ—অর্থাৎ সামাজিক, পারিবারিক, জৈবিক এসব কারণ নারীকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় দুই কোটি নারী ও পুরুষ আত্মহননের চেষ্টা করে। এরমধ্যে ‘সফল’ হন (মারা যান) প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেন। আর উপমহাদেশে অন্তত ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মহত্যার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এ দেশে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যাই বেশি, যাদের বয়স ১৪ থেকে ৩০ বছর।
আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিসংখ্যানও প্রায় কাছাকাছি।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (বাংলাদেশ) পরিচালিত ২০১৩ সালের এক জরিপের তথ্যমতে, প্রতিবছর দেশে গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করে। বিভিন্ন বয়স, লিঙ্গ, পেশা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের নিরিখে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৪২৯ জনের ওপর সরাসরি জরিপ চালিয়ে তারা এ তথ্য প্রকাশ করে। আর শহরের চেয়ে গ্রামে আত্মহত্যার হার ১৭ গুণ বেশি। গ্রামে যারা আত্মহত্যা করে, তাদের বড় অংশই অশিক্ষিত এবং দরিদ্র। ওই জরিপে বলা হয়, নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। এর বাইরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ও রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে অনেকে আত্মহত্যা করেন। পুলিশের তথ্যমতে, দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে যত রোগী ভর্তি হয়, তার সর্বোচ্চ ২০ ভাগ হচ্ছে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকজন।
বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমা বলেন, ‘নারীরা এখন ঘরে-বাইরে কাজ করছে। তাদের ওপরে এখন চাপটা অনেক বেশি। তারা চাকরি করছে। সেখানে ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। ছেলেদের চেয়ে ভালো পারে এটা প্রমাণ করার জন্য নারীকে দ্বিগুণ কাজ করতে হচ্ছে। আবার বাসায় ফিরে গিয়েও সব কাজ তাকে করতে হচ্ছে। এখানে না স্বামী না শ্বশুরবাড়ির লোকজন, কেউই ছাড় দিচ্ছে না। সন্তান দেখা থেকে শুরু করে সবই নারীকে করতে হয়। এই দুটো চাপ মিলে নারীর ভেতরে একটা মানসিক অশান্তি তৈরি হয়, যা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট দীপ্তি শিকদার বলেন, ‘যৌতুকের নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা সহ্য করতে না পেরে নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। এসব কারণে একজন নারীর মধ্যে হতাশা বেশি থাকে। অনেক সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে কোনও ঝামেলা হলে নিজের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে ডিপ্রেসনে ভুগে ছাত্রছাত্রীরা আত্মহত্যা করছে।’
আবার দেখা যাচ্ছে, কিশোরী মেয়েরা যৌন নিপীড়ন ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেক সময় কোনও সাহসী মেয়েকেও সমাজ মেনে না নিয়ে তিরস্কার করে। এভাবেও নারীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। চারুকলার ছাত্রী সিমি ছিল অত্যন্ত প্রতিবাদী মেয়ে। তাকে বাড়িতে এসে একজন পুলিশ সদস্য পর্যন্ত থ্রেট দিয়ে গেছে যে তুমি কেন নিজেকে শেষ করে দাও না? মেয়েদের যে সমাজে অবদমিত করে রাখা হয়, মেয়েদের বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না, এগুলোও তাদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।
দীপ্তি শিকদার বলেন, ‘আবার নারীকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মিথ্যা প্রচারণাও পরে আত্মহত্যা বলেই স্বীকৃতি পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সেলিনা ফাতেমা বিনতে শহীদ বলেন, ‘জৈবিকভাবে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আলাদা, তেমনি মানসিকভাবেও আলাদা। মেয়েরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়। দেখা যায় যে যখন মেয়েরা আবেগটা দমন করতে পারে না, তখন আত্মহত্যা করে বসে। এখানে ইমোশনটা রিলেটেড। হতাশা, নিজেকে দোষী ভাবা থেকে রেহাই পেতে তারা আত্মহত্যা করে। অনেক সময় দেখা যায়, মেয়েরা বিষণ্নতায় বেশি ভোগে। সেই ক্ষেত্রেও মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েরা সামাজিক বৈষম্যেরও বেশি শিকার হয়। পারিবারিক, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে সবখানে মেয়েরা বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তারা অপমানগুলো নিজের ভেতরে রাখে। কাউকে বলে না, বললে কাজ হয় না। তখন তার নিজের সম্পর্কে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। একটা ছেলে কিন্তু এত সহজে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে না। মেয়েরা তো অনেক সময় পারিপার্শ্বিকতার ওপর নির্ভরশীল থাকে। কোনও ব্যক্তির ওপর এই নির্ভরশীলতা। কালচারই তাকে নির্ভরশীল করে তৈরি করেছে। এই নির্ভরতার জায়গাটা যখন সরে যায়, তখন সে মনে করে তাকে দেখার কেউ নেই। সে কিছুই পারবে না। তখন ভাবে যে তার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই।’
নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা রোধ করার বিষয়ে ডা. সেলিনা ফাতেমা বলেন, ‘আবেগের জায়গাগুলো অনেকেই বুঝতে চায় না। বেশিরভাগই কোনও না কোনও সংকেত দেয়। আগে থেকেই বোঝা যায়, বুঝলেও অনেকে মনে করে হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারগুলো এড়িয়ে না গিয়ে যেটা করা যায়, তাদের প্রতি সচেতন হওয়া, তাদের আবেগের প্রতি সচেতন হওয়া, বিষণ্নতায় ভুগলে তার চিকিৎসা করা। নারীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা, পরিবারে যেন বৈষম্যের শিকার না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া। যেকোনও দুঃখকে জয় করা, আনন্দের সঙ্গে জীবনযাপন করা, এগুলো ছেলেমেয়ে সবাইকে শেখালে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসবে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে—এমন মানুষকে যদি চিহ্নিত করা যায়, তবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কথা বলার সুযোগ পেলে, ওই ব্যক্তিকে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলা ট্রিবিউন