আভা ডেস্ক : মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের বিচার পাওয়ার পথ তৈরির প্রক্রিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।
আন্তর্জাতিক এই প্যানেল রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করবে।
এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের ভবিষ্যতে বিচারের মুখোমুখি করতে মামলার নথি তৈরির কাজও এই প্যানেল এগিয়ে নেবে।
জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে মিয়ানমারে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করার পর মানবাধিকার কাউন্সিলের এ সিদ্ধান্ত এল।
রয়টার্স জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার জেনিভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে ভোটাভুটির মাধ্যমে এই প্যানেল তৈরির প্রস্তাব পাস হয়।
৪৭ সদস্যের এই কমিশনে প্রস্তাবের পক্ষে ৩৫ এবং বিপক্ষে তিন ভোট পড়ে। সাত সদস্য দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসির আনা ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভোট দেয় কেবল মিয়ানমারের মিত্র চীন, ফিলিপিন্স ও বুরুন্ডি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জেনিভা শাখার পরিচালক জন ফিশার বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। সেসব ঘটনার জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করতে মানবাধিকার কাউন্সিলের এ পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সেনাবাহিনীর অপরাধের দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি মিয়ানমারে গড়ে উঠেছে, তা ভাঙতে এই প্যানেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন ফিশার।
মানবাধিকার কাউন্সিলের অনুমোদন পাওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারে গুরুতর যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটেছে, সেসব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পর্যালোচনা করবে এই আন্তর্জাতিক প্যানেল।পাশাপাশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারের লক্ষ্যে ফৌজদারি মামলার নথিপত্র তৈরির কাজ এগিয়ে নেবে এই প্যানেল।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই প্যানেলের জন্য কর্মী নিয়োগ ও তহবিল যোগানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রস্তাবে।
জন ফিশার বলেন, “জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের উচিৎ মানবাধিকার কাউন্সিলের এই নতুন প্যানেলকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে মিয়ানমারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাওপোড়াওয়ের বিচারের উদ্যোগকে সমর্থন জানানো।”
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস রেসপন্স বিভাগের পরিচালক তিরানা হাসান এক বিবৃতিতে বলেন, “মিয়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মানবাধিকার কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি মিয়ানমারের নিপীড়িত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর বিচার পাওয়ার পথ সুগম হবে।”
মানবাধিকার কাউন্সিলে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় চীনের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের কথায় পাওয়া যায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে উপস্থাপন করা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং জ্যেষ্ঠ পাঁচ জেনারেলকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলা হয়।
এই মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান বলেছেন, “তাতমাদো যতদিন আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে, ততদিন শান্তি ফেরানো সম্ভব হবে না। মিয়ানমারের উন্নয়ন এবং একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে দেশটির সেনাবাহিনীই সবচেয়ে বড় বাধা।”
এদিকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলামদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক তদন্তও শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।
এর জবাবে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেছেন, তার দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কোনো দেশ, সংস্থা বা গোষ্ঠীর নেই।
আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গতবছরের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও এখনও প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।