জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ কামরুজ্জামান হেনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ঃ

‘বাবার মৃত্যুর সময় আমি ইলেভেন ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। ছোট ভাই স্বপন ছিল ক্লাস নাইনে। তখন আমরা দু’ভাই ভারতের কলকাতার অদূরে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র ছিলাম। বাবার মৃত্যুর খবর পাই ৫ নভেম্বর সকালে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান, বড় মহারাজের (স্বামী লোকেশ্বরানন্দর) কাছে। বিলম্বে সংবাদ পাওয়ার কারণ সে সময় রেডিও-টেলিভিশন এখনকার মতো ছিল না।

৪ নভেম্বর বিকালে হোস্টেলের কেয়ারটেকার আমাদের ডেকে বললেন, বড় মহারাজ আপনাদের ডেকেছেন। ওই দিনই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রামকৃষ্ণ মিশনের কালচারাল সেন্টারের আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে। পরদিন সকালে স্বামীজী আগের দিনের (৪ নভেম্বর) আনন্দবাজার, যুগান্তর এবং অমৃতবাজার পত্রিকা হাতে নিয়ে এসে অনেকক্ষণ আমাদের দু’ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলতে থাকলেন, পৃথিবীতে কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেন না।

কেউ আগে চলে যান, আর কেউ পরে। কেন তিনি এসব কথা বলছিলেন আমরা তাৎক্ষণিক তা বুঝতে পারিনি। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমরা যাতে ভেঙ্গে না পড়ি, সম্ভবত এজন্য ঘরের বাইরে গেলেন।পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় বাবাসহ জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যার খবর ছবিসহ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। পত্রিকা দেখে আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম এই হত্যাকা-ের খবর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ছোট ভাই স্বপন অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। আমিও কিছুতেই নিজেকে সামাল দিতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। একটু পরে মহারাজ ঘরে আসলেন। বাবাসহ জাতীয় চার নেতার নৃশংস হত্যাকান্ডের খবরে আমাদের মতো তিনিও সম্ভবত খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন।

একসঙ্গে পরিবারের নানা কথাবার্তা মনে পড়তে লাগল। মা, বড় আপা, মেজো আপা আর ছোট বোন চুমকির কথা। বাবা-মা, বোনদেরসহ সকলের মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভাসতে লাগল। তাঁরা কেমন আছেন? বাড়িতে কিভাবে যোগাযোগ করবো- আমাদের এসব প্রশ্নের জবাবে বড় মহারাজ বললেন, উনারা ভাল আছেন, আমরা খবর নিয়ে জেনেছি বাবার হত্যাকান্ডে পর ২/৩ মাস পর্যন্ত আমরা বাড়িতে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে পারিনি। কেবল লোক মারফত খবর জেনেছি। বাবার মৃত্যুর আগে সেই বছর রাজশাহী থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মেজো বোন দুর্ঘটনার শিকার হলো, সব মিলিয়ে একটা দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা।

রাজশাহীতে থাকাকালীন বাবাকে খুব কম সময়ই কাছে পেতাম। বেশিরভাগ সময়ই আমরা ঘুমানোর পর তিনি বাড়ি ফিরতেন। আবার ঘুম থেকে উঠেই প্রচুর লোকের ভিড়ে বাবা হারিয়ে যেতেন। এছাড়া পার্লামেন্ট অধিবেশনের কারণে বাবা বছরের প্রায় ৬ মাস থাকতেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তখন আমরা ভাই-বোনেরা মাঝে মাঝে বাবার উপর মনে মনে খুব রাগ করতাম। এখন বুঝি, দেশ ও জনগণের জন্য যাঁরা কাজ করেন, পরিবারের মাঝে কাটানোর মতো সময় তাঁদের হাতে বেশি থাকে না। দেশের মানুষকে বাবা কত ভালবাসতেন, তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গেলে এখন বুঝতে পারি। দীর্ঘ ৪২ বছর পর এখনও অনেক মানুষ বিশেষ করে বৃদ্ধরা বাবার পরিচয় পেলে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

আমি বাবাকে প্রচ- রকমের ভয় করতাম। দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম সব সময়। বাবা বোনদের আদর করতেন বেশি। তাদের জন্য কসমেটিক আনতেন। আমরা কাঁদলে বাবা বলতেন, ছেলেরা নিজেরাই নেবে। ওরা কেন নির্ভরশীল হবে? ওদের নির্ভরশীল করতে চাই না। বাবা ঘরের মেঝেতে পাটি পেতে বসে খেতেন। কাঁসার থালা-গ্লাস ব্যবহার করতেন। সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি আমাদের নিজের হাতে খাওয়ালেন। তখন ইলিশ মাছ কম দামে পাওয়া যেত। তরকারির বাটি থেকে ইলিশ মাছের পিস দু’ভাইয়ের প্লেটে তুলে দিলেন। এর আগে তিনি কখনও নিজের হাতে আমাদের খাওয়াননি। তখনকার দিনে কাঁচা রাস্তার কারণে বাবা নৌকা বা গরুর গাড়িতে চলাফেরা করতেন। কখনও চলাফেরা করতেন সুগার মিলেন টিএ খানের জীপে করে। তার অন্যতম শখ ছিল পাখি এবং মাছ শিকার। কয়েকজন মিলে একসঙ্গে শিকারে বের হতেন। অনেকের মুখে তা বলতেও শুনেছি।

মুসলিম লীগের বড় বড় নেতার সঙ্গে বাবার ভাল সম্পর্ক ছিল। তিনি সকলের সাথে আন্তরিকভাবে মিশতে পারতেন। পান খেতে পছন্দ করতেন। ’৫৫-’৫৬ সালে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর মক্কেলরা বেশিরভাগ ছিলেন ফ্রি। বিশেষ করে যাঁরা আইয়ুব শাসন-শোষণে নির্যাতিত হতেন। মায়ের মুখে শুনেছি, বাবার পকেটে কম টাকা থাকত। ’৫৭-তে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। ’৬৭-তে বেতন বেড়ে ১৫’শ টাকা হলে মা প্রতি মাসে তা থেকে ২০০-২৫০ টাকা বাঁচাতেন। মালোপাড়ার বাড়িটা সেই বাঁচানো টাকা দিয়েই কেনা। ’৬৮ সালে পার্লামেন্টের অধিবেশনে যোগ দিতে বাবা পশ্চিম পাকিস্তান গেলেন।

আমরা দু’ভাইও তাঁর সাথে গেলাম। দেড় মাস ছিলাম সেখানে। বাবা আমাদের মাঝে মধ্যে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শহর ঘুরে দেখাতেন। সে সময় পাকিস্তানের শহরকে ইউরোপের শহর মনে হতো। আমরা এমপি হোস্টেলের একতলা বিল্ডিংয়ে থাকতাম। মাঝে লেন, গার্ডেন লাইট-চমৎকার স্মৃতি। এক অধিবেশনের দিন বাবা আমাদের সঙ্গে করে পার্লামেন্ট ভবনে নিয়ে গেলেন। স্বপ্নের মতো মনে হলো। সেখানকার ক্যাফেতে আমাদের বসিয়ে রেখে বাবা ভিতরে গেলেন। ওয়েটার মেন্যু দেখাল। আমরা একটু পর পর খাবারের অর্ডার দিলাম। বাবা বেরিয়ে আসার পর আইয়ুব খানের লম্বা-চওড়া মোটাসোটা পুত্র গরহর আইয়ুব বাবাকে জড়িয়ে ধরলেন। পরে পরিচিত হলাম তাঁর সঙ্গে। একদিন সবুর খানের বাসায় বেড়াতে গেলাম। নিজ শহর রাজশাহীর বাইরে পৃথিবী কেমন হতে পারে তা স্বচক্ষে দেখলাম।

বাবা সব সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা ভাবতেন। কিন্তু তখন এই অঞ্চলের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় ছিল নদী। ’৬৭ সালের ২৭ জুন তিনিই প্রথম পার্লামেন্টের বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর পাঁচটি জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণের দাবি উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে তিনি অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। স্বাধীনতার পর স্বল্পতম সময়েও তিনি সকল দলমত আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে থেকে জনগণের জন্য কাজ করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি অসংখ্য সমাজসেবামূলক কর্মেও আত্মনিয়োগ করেন তিনি।

তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উত্তরাঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বিশেষ করে রাজশাহীর নওহাটা কলেজ, কাটাখালি আদর্শ কলেজ, দাওকান্দি কলেজ, তাহেরপুর কলেজ, গোদাগাড়ী কলেজ, আড়ানী কলেজ, বগুড়ার জাহানারা কামরুজ্জামান কলেজ, দুপচাঁচিয়া কলেজ, আদমদিঘী কলেজ, রাজশাহী সরকারী ইন্টারমিডিয়েট কলেজকে ডিগ্রীতে উন্নীতকরণ প্রভৃতি তার অবদান। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, রাজশাহী বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরী, হুজরীপাড়া হেলথ কমপ্লেক্স, রাজশাহী টেক্সটাইল মিল, রাজবাড়ি ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম, রাজশাহী নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং একশ বিঘা জমির উপর রাজশাহীর একমাত্র কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রাজশাহী-নওগাঁ সড়ক নির্মাণ কাজ শুরুর আপ্রাণ চেষ্টাসহ অবহেলিত রাজশাহী ও উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নে তাঁর আরও অনেক পরিকল্পনা ছিল, যা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।

বাবার জীবনী লেখার সময় বুঝলাম তিনি কেমন মেধাবী ছিলেন। জমিদার হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। একজন প্রভাবশালী নেতা এবং এমএনএ হওয়া সত্ত্বেও মালোপাড়ার একটি সাধারণ বাড়িতে তিনি বসবাস করতেন। টিউবওয়েলের পাশে কুয়ার পানিতে গোসল করতেন। একবার মামা বেড়াতে এসে তো মাকে বলেই ফেললেন, মেয়েরা বড় হয়েছে, একটা বাথরুম বসাও। বাবার সততা নিয়ে প্রশ্নের অবতারণা করা যাবে না। স্বাধীনতার পর স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং বাণিজ্যমন্ত্রী হন। ’৭২-এ ছোট বোনকে নিয়ে বঙ্গভবনে উঠলেন। বিশাল দায়িত্ব পড়ল কাঁধে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে কোটি কোটি টাকার ত্রাণ আসল তাঁর হাতে। ওই ত্রাণ বিতরণে তার কোন অস্বচ্ছতা পাওয়া যায়নি। এ কারণে দুরূহ অনেক কাজ বঙ্গবন্ধু তাঁর হাতে দিতেন। দেশের জনগণের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালবাসা এবং জনগণও তাঁকে যেভাবে ভালবেসেছেন তাতে আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠে।

আরও গর্ব হয় এই ভেবে যে, তিনি জীবন দিয়েছেন কিন্তু জাতির সঙ্গে এমনকি জাতির জনকের সঙ্গে বেঈমানি করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর বাবাকে খুনীচক্রের প্রধান খন্দকার মোশতাকের অবৈধ সরকারে যোগ দেয়ার জন্য নানাভাবে ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখানো হয়। কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। মোশতাকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তাঁর কী পরিণতি হবে জেনেও তিনি বলেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই, সেখানে আমার মতো মানুষ বেঁচে থেকে লাভ কী? গ্রেফতার হওয়ার আগে বাবা মাকে বলেছিলেন, আমরা গ্রেফতার হলে মনে হয় জেল থেকে আর জীবিত বের হতে পারব না।

এর পরই তাঁকেসহ অপর জাতীয় তিন নেতাকে গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। বাবার বিরুদ্ধে ঢাকার একটি পরিত্যক্ত কারখানা দখলের মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়। ওই মামলার শুনানি নিষ্পত্তির আগেই ৩ নভেম্বর নৃশংসভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। পরে আদালতের রায়ে অবশ্য বাবা নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন। বাবা জেলে যাওয়ার আগে মাকে তাঁর অনেক বন্ধুর কথা বলতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরা কেউ আমাদের অসহায় পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। বাবার মৃত্যুর পর মাকে ধার-দেনা করে সন্তানদের বড় এবং তার মেয়েদের বিয়ে দিতে হয়েছিল।

একবার মাকে নিয়ে বাবা ইউরোপে গিয়েছিলেন। সেখানকার একটি হোটেলে বাংলাদেশের এক লোক বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু বাবা বাথরুমে থাকায় লোকটি মার কাছে একটি ব্রিফকেস রেখে বাবার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যান। বাবা বাথরুম থেকে বের হলে মা তাঁকে ব্রিফকেসের কথা বলেন। বাবা তখন মাকে বলেন, তুমি ওটা নিলে কেন? পরে বাবা ব্রিফকেসটা মাকে খুলতে বলেন। সেটি খোলার পর দেখা যায় ভেতরে তাক করে সাজানো বিশ্বের সবচেয়ে দামী পাউন্ড। বাবা সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে বলেন, এখনি ব্রিফকেসটি ওই লোককে দিয়ে আসুন। আরেকবার বাবা বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে দেশের গরিব মহিলাদের জন্য কম মূল্যে শাড়ি দেয়ার জন্য টেন্ডার আহবান করা হলো। জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কোম্পানি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে।

তাদের প্রতিনিধিনা বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভারতীয় কোম্পানির কোয়ালিটি ছিল সবচেয়ে নিন্মমানের, কাপড়ও ছিল খুবই পাতলা। ওই কাপড় মা-বোনেরা ১৫ দিনের বেশি পড়তে পারবেন না। ওই ব্যবসায়ী গ্রুপটি তাদের কোম্পানিকে টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দিতে বাবাকে খুব পীড়াপীড়ি করে। লোক মারফর প্রস্তাবও পাঠায় কত টাকা চান? কিন্তু বাবা তাদের ফিরিয়ে দেন। পরে তাঁরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে যান এবং তিনি (শেখ মুজিব) বাবাকে ফোন করে তাদের ফিরিয়ে দেয়ার কারণ জানতে চান। বাবা তাকে ঘটনা খুলে বলেন এবং স্যাম্পল পাঠান। পরে তিনি বাবাকে বলেন, তুমি ঠিকই করেছ। ওই কোম্পানিকে পরে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়।

একবার বাবা আমাদের হেলিকপ্টারে করে রাজশাহীতে নিয়ে আসলেন। পালপুর স্কুল মাঠে হেলিকপ্টার থেকে নেমে আমরা দু’ভাই ঘোরাঘুরি করছি। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে আমাকে বললেন, বাবা, আমার জমিজমা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। তুমি যদি তোমার বাবাকে বলে সমস্যা সমাধান করে দাও তাহলে তোমাকে আমি ১০ বিঘা জমি লিখে দেব। কাদিরগঞ্জে দাদার বাড়িতে বাবাকে ওই লোকের কথা বলায়, তিনি আমাকে ধমক দিলেন। তখন আমি পালাবার পথ খুঁজে পাইনি।

পড়ালেখা শেষে বাবার কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে সোনালী ব্যাংকের দু’টি চেকবই পেলাম। সে সময় আব্দুল জলিল সংসদের চীফ হুইপ ছিলেন। তাঁর সহায়তায় ’৮৫-৮৬ সালে বাবার দুটি ব্যাংকের হিসাবে মাত্র ৭,২০০/- টাকা জমা পেলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যে লোক স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং পরে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি মৃত্যুর সময় মাত্র এই কটা টাকা রেখে গেছেন। তখন মনের মধ্যে বাবার একটি কথা ঘুরপাক খেতে লাগল। সেটি হলো, রামকৃষ্ণ মিশনে ইলেভেন ক্লাসে সেকেন্ড কোয়ার্টার পরীক্ষায় গণিতে কম মার্কস পাওয়ায় বাবা বলেছিলেন, এই মার্কস নিয়ে কী হবে? আমি তো তোমাদের জন্য কোটি কোটি টাকা রেখে যাব না।

ব্যক্তিগতভাবে বাবা ছিলেন খুবই রসিক এবং মেধাবী। দু’টি রূপ ছিল তাঁর। বাইরে এক রকম, বাড়িতে আরেক রকম। বাইরে রসিকতা ও হাসিঠাট্টা করে অনেক কথা বলতেন। কিন্তু বাড়িতে তিনি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। প্রায় রাত ১টার দিকে বাড়িতে ফিরতেন, বের হতেন সকাল ১০টার মধ্যে। ভোরে স্কুলে যাওয়ার কারণে বাবার সঙ্গে কখনও ১৫/২০ দিন পর্যন্ত দেখা হতো না। তবে রুচিশীল মানুষ ছিলেন তিনি। কলকাতার ‘বাবা’ জর্দা দিয়ে পান খেতেন সব সময়। মৃত্যুর আগে বাসায় বেশ কয়েক বার গানের আসর বসান। এতে অংশ নিতেন আব্দুল জব্বার, তপন মাহমুদ, আপেল মাহমুদ প্রমূখ। ঘুম থেকে দেরিতে ওঠায় বেডরুমেই বাইরের লোকদের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের কাছে জেনেছি, বাবা খুব আন্তরিক লোক ছিলেন। একজন মায়ের অসুখে ছুটির জন্য আবেদন করেন। ওই আবেদনে তিনি লিখেন, ‘মা যখন দিয়েছে ডাক, কী করে বলি অফিসে থাক।’ তখনকার দিনের প্রচলন ছিল আত্মীয়-স্বজন কারও বাড়িতে গেলে মুরগি, বড় মাছ বা ফলমূল নিয়ে যেত। এসব দিয়েই অনেকে ধন্য হতেন। বলতেন, হেনা ভাই খেলে ধন্য হব। আর যাঁরা বাবাকে খুশি করতে চেয়েছেন তাঁরা ১০টি ‘বাবা’ জর্দার কৌটা এনে বাবাকে দিয়েছেন।

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করতে চেয়েছিল তারাই মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে না দেয়ার জন্য সপরিবারে জাতির পিতা শেখ মুজিব এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছিল। জাতীয় চার নেতার কবর একসঙ্গে থাকলে ভাল হতো। রাজশাহীতে বাবার কবর থাকায় অনেকে এখানে কষ্ট করে আসতে চান না। মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন তাঁর জীবন ও কর্মের যথাযোগ্য মূল্যায়ন হয়নি। যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মৃত্যু বার্ষিকীও পালিত হয়নি।

লেখক: জাতীয় নেতা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের ছেলে এবং

রাজশাহী সিটি মেয়র, সভাপতি, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ

এই লেখাটি লেখকের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে।

Next Post

রাজপাড়া থানার অফিসার ইনচার্জ কে মানবাধিকার জোটের সম্মাননা ক্রেস প্রদান।

শনি নভে. ৩ , ২০১৮
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজপাড়া থানা অফিসার ইনর্চাজ হাফিজুর রহমানকে মানবাধিকার জোটের পক্ষে সম্মাননা ক্রেস প্রদান। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় মানবাধিকার জোটের পক্ষ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা পিস এ্যাওয়ার্ড ২০১৮ সম্মাননা সনদ ও ক্রেস প্রদান করেন। আর এম পি রাজপাড়া থানার এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখেছেন অফিসার ইনর্চাজ হাফিজুর রহমান, […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links