কেশরহাটে ঋণের বোঝায় ব্যবসায়ীর আত্মহত্যা!

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার কেশরহাটে  ইট-বালু ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসি ও নিহতের পরিবারের দাবি, একই এলাকার আলোচিত সুদ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের প্ররোচনায় ও টাকার জন্য অতিরিক্ত চাপে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ইট-বালু ব্যবসায়ী ইব্রাহিম কারিগর (৬১)। কেশরহাট পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের মৃত তমির কারিগরে ছেলে ছিলেন তিনি। অপরদিকে  সুদ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম (২৮) একই গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী আব্দুস সালামের ছেলে।

সরজমিনে ঘটনাস্থল জুড়ে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ব্যবসার প্রয়োজনে প্রথম ধাপে সুদ ব্যবসায়ী সাইফুলের নিকট হতে ইব্রাহীম কারিগর ২ লাখ টাকা দাদন নেন, পরে সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে ইব্রাহীম কারিগরের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা আদায় করতে চাই। এই টাকা দিতে ইব্রাহীম কারিগর অপারগ হলে সাইফুল নিহত ইব্রাহিম কারিগরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ২ টি ট্রাক্টর, ২ টি ট্রলির চাবি, খাতাপত্র ও সিমেন্টের দোকান জোরপূর্বক কেড়ে নিতে চায় এবং জনসাধারণের কাছে নিজ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি প্রচার দিতে গত প্রহেলা মে শ্রমিক দিবস উপলক্ষ্যে ইব্রাহিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে “ভাই ভাই হার্ডওয়্যার ষ্টোর” বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজে মালিক দাবি করে শ্রমিকদের মাঝে গেঞ্জি বিতরণ করে। এর আগের দিন ৩০ এপ্রিল দুপুর থেকে নিখোঁজ হোন ইব্রাহিম কারিগর। মুলত সেই দিন দুপুরে ইব্রাহীম কারিগরের নিকট হতে সাইফুল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব কিছু লিখে নিতে চাইলে তিনি বাড়ি থেকে গোসল করে খাবার খেয়ে এসে লিখে দিতে চেয়ে চলে যান। এরপর তিনি বাড়ি চলে গেলে কিছুক্ষণ পরপর সাইফুল ফোন দিয়ে গালিগালাজ ও ভয়ভীতি দেখান বলে দাবি করেন নিহত ইব্রাহিমের পরিবারের সদস্যরা। ইব্রাহীমের স্ত্রী সেলিনা বিবি বলেন, সাইফুল আমার স্বামীকে প্রায় চাপ দিতো, নিখোঁজের দিন দুপুরের খাবার পর সাইফুলের ফোন আসায় সে বাড়ি থেকে বের হয়, এরপর থেকে তার ফোন বন্ধ দেখায়। পরে আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোন সন্ধান পাইনা। নিখোঁজের পর ৩ মে (বুধবার) সকালে ইব্রাহীমের গলাই দড়ি দেওয়া ঝুলন্ত লাশ তারই মেয়ে জামাইয়ের নির্মাণধীন বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন পুলিশ। পরিবারের সসদস্যের পাশাপাশি এলাকাবাসির দাবি সুদখোর সাইফুলের একের পর এক অমানষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কীটনাশক বিষ পান করে ও পরে গলায় দড়ি নিয়ে ইব্রাহীম আত্মহত্যা করেছে।

আরো জানা যায়, ইব্রাহীমের দাফন কার্য শেষ হলে পরদিন সকালেই তার ইট-বালুর ব্যবসা দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছিলো সুদখোর সাইফুল ইসলাম। স্থানীয়রা এসে তা রক্ষা করে এবং খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশও আসেন। বর্তমানে সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব পান ইব্রাহীমের ছোট মেয়ে জামাই সুবহান আলী (২৭)। আর খাতাপত্রসহ পুরনো হিসেব-নিকেশ এর দায়িত্ব নেন কেশরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম, পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সাত্তারসহ মোট ৭ জন সদস্য।

গ্রামবাসীরা জানান, সাইফুল এলাকার বড় একজন সুদ কারবারি। তার দেয়া সুদের টাকায় চলে অনেক মানুষের  ব্যবসা-বানিজ্য। সাইফুল নানীর সেই মাটির কুঁড়ে ঘরে থেকে অল্প সময়েই কিনেছে পাকা বাড়ি। নিজস্ব সম্পদ বাড়াতে একাধিক স্থানে কিনেছে ভিটামাটি। বাকশৈল গ্রামের এক ব্যক্তিকে ৭টি বড় বড় গরু কিনে দাদন দিয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া তার আরও নানা জনের নিকট ৪০/৪৫ টি গরু দাদনে রয়েছে বলে জানা গেছে।

ইব্রাহিমের ছোট মেয়ের জামাই সুবহান আলী বলেন, আমি কয়েক বছর আগে সুদখোর সাইফুলের কাছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা সুদের উপর নিয়ে নিয়মিত প্রতি মাসের সুদের টাকা দিয়েছি। ৬০ হাজার আসল টাকা পরিশোধ করার পরও সাইফুল আমার বিরুদ্ধে আদালতে সাড়ে ৪ লাখ টাকার মিথ্যা মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় দীর্ঘদিন হাজত খেটে জামিনে মুক্তি পায়। আমার শ্বশুরও তার কাছ থেকে সুদের উপর ২ লাখ টাকা নিয়েছে বলে শুনেছি। আর তাদের টাকার হিসাব আমাদের সামনে করতো না। একটু আড়ালে গিয়ে তারা এ আলাপ করতেন। পরে সাইফুলের মাধ্যমেই জানতে পারলাম, সে আমার শ্বশুরের নিকট হতে সুদাসল ১৪ লাখ টাকার উপরে পাবে। এই টাকা নিতে অতিরিক্ত চাপ দেয়ায় আমার শ্বশুর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে আমি মনে করছি। এমনকি আমার শ্বশুর নিখোঁজ হওয়ার পর সাইফুলকে ফোন করলে সাইফুল আমাকে বলে সে গোদাগাড়ীতে আছে। আর আমার শ্বশুরের সাথে তার নাকি ৪০ সেকেন্ডের মতো ফোন আলাপও হয়েছে।

ইব্রাহীমের মেয়ে সারমিন বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি আমার বাবা সাইফুলকে নিয়ে খুব চিন্তা করতেন। সাইফুল দিনে কয়েকবার করে টাকা চেয়ে আমার বাবাকে ফোন দিতো।

ইব্রাহীমের শালী রূপালী বলেন, এলাকার সবাই জানে সাইফুল সুদের উপর টাকা খাটিয়ে লাভবান হয়েছে। আর তার স্বার্থে সব সময় মানুষদের নানান ভাবে হয়রানি করে।

ইব্রাহীমের আপন চাচাতো ভাই আব্দুল মালেক বলেন, সুদখোর সাইফুল যখন ইব্রাহীমের দোকানঘর লিখে নিতে হুমকি দিছে এরপরই আমার ভাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

ইব্রাহীমের আপন ভাই নমীর উদ্দিন বলেন, আমার ভাই সাইফুলের চাপ সইতে না পারায় মারা গেছে। আমরা সাইফুলের বিচার দাবি করছি। আমার ভাস্তি ইব্রাহীম ভায়ের বড় মেয়ে চাকরির কারনে বাহিরে আছে। সে বাড়িতে আসলে আমরা পারিবারিকভাবে পরামর্শ করে মামলা করবো।

বাকশৈল গ্রামের বাসিন্দা ইলিয়াস, মুকুল, মিজান সহ একাধিক গ্রামবাসি বলেন, সাইফুলের বাবা একজন মাদক ব্যবসায়ী ও গাঁজাখোর। তার ছেলে সাইফুল এলাকার কয়েকটি গ্রাম্য সমিতির ক্যাশিয়ার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করে এবং সমিতির সদস্যদের কাছে হাজারে ৫০ টাকা ও বাহিরের লোকজনের কাছে হাজারে ১০০ টাকা সুদের হারে টাকা দেয়। এর বিনিময়ে সে ব্যাংক চেক ও ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। পরে তার সুদের জালে বেধে মামলা করে জেল জরিমানা করে অনেক টাকা হাতিয়ে আজ সে এলাকায় কোটি টাকার কারবার করছে। এভাবে সে বাড়ি, জমি, গরু সহ অনেক সম্পদ কিনেছে। তার এই দুর্নীতি মুলক ও সুদের ব্যবসার অপরাধে ও সর্বোশেষ ইব্রহীমের মৃত্যু কারণ বিবেচনা করে তার কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার বলে আমরা মনে করছি।

কেশরহাট মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন বলেন, সাইফুল আমাদের মাছ বাজারে সামান্য কর্মচারি হিসেবে দিন-মজুরের কাজ করে। এতে করে সে দিনে ৩০০-৬০০ টাকা আয় করে। তার সুদের ব্যবসার কথা লোক মুখে শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে আমরা তেমন কিছু জানিনা। বালু ব্যবসী ইব্রাহীমের ঘটনার পর থেকে সাইফুল আর মাছ বাজারে আসছেনা।

কেশরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, মৃত ইব্রাহীম আমার নিকট আত্মীয়। তার মৃত্যুর ঘটনার পরদিন তার দোকানসহ খাতাপত্র তসনস হওয়ার সংশয় দেখা দিলে পৌর মেয়রের সহযোগিতায় তা রক্ষা করেছি।

কেশরহাট পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও বাকৈশল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল সাত্তার বলেন, আমরা ইব্রাহীমের সকল লেন দেনের কাগজপত্র পর্যালোনা করছি। পর্যালোনা শেষে জানানো যাবে ইব্রাহীমের কাছ থেকে কে কত টাকা পাবে এবং সে দোকানের বাকি দেওয়া টাকা কার কাছ থেকে কত টাকা পাবে।

এবিষয়ে কেশরহাট পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান বলেন, ইব্রাহীমের লাশ দাফনের পরদিন সকালে ইব্রাহিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন জিনিসপত্র সহ খাতা পত্র নিয়ে তোড়জোড় শুরু হলে আমাকে খবর দেয়া হয় এবং আমি নিজে গিয়ে দোকান ঘর তালাবদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সহ ৭ জনকে হিসাব-নিকাশের খাতাপত্র হেফাজতের দায়িত্ব নেয়ার ব্যবস্থা করেছি। সুদের ব্যবস্যা করা আইনগত অপরাধ। সুদ ও সুদ কারবারিদের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং সুদকারবারীদের আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।

এবিষয়ে মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সেলিম বাদশাহ বলেন, ইব্রাহীমের মৃতদেহ উদ্ধারের পর তার ছেলের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে লাশের ময়না তদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর তার মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এঘটনার পর থেকে সাইফুল অসুস্থ্যতা দাবি করে এলাকা থেকে পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

Next Post

মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন

সোম মে ১৫ , ২০২৩
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের অভিযোগ উঠেছে। সরকারীভাবে রোগীদের উন্নতমানের খাবার বরাদ্দ দেয়া হলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালটির’র কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  রোগীদের ভাষ্যমতে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের এতোটাই নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হয় যা […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links