Ava desk : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় ঢাকার মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহত হন। এ ঘটনার দীর্ঘদিন পর মামলা হলেও বিচার কাজ শেষ হচ্ছে না। এক যুগ আগে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন (অভিযোগ) করা হয়। আদালতে সাক্ষী না আসায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৫ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। চার বছরে কোনো সাক্ষী হাজির হননি। মামলার বিচার কাজ ঝুলে গেছে। এদিকে মামলার সর্বশেষ তারিখ ৯ আগস্ট আট আসামির বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করেছেন আদালত।
মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে জানান, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের তার ৮ নম্বরের বাসায় কামানের গোলা পড়ে। তখন বাসার ভাড়াটিয়া ও গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিল। কামানের গোলায় তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় সেই সময় মামলা করতে গেলে তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানার ওসি রব মামলা নেননি। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অজুহাতে মামলা না নিয়ে তিনি ফিরিয়ে দেন। একপর্যায়ে ১৫ আগস্টের ঘটনায় কোনো মামলা করা যাবে না- এ সংক্রান্ত আইন পাস হলে মামলা করা আর সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই কালো আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুর থানায় তিনি মামলাটি করেন। তার দাবি, পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। এ ঘটনার সময় উপস্থিত তার পরিচিত অনেকেই রয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে তারাও সাক্ষ্য দেবেন। তিনি আরও বলেন, ওই দিনের ঘটনার শিকার হতদরিদ্র পরিবারগুলোর খবর কখনও কেউ নেয়নি। তাদের কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তাও দেয়া হয়নি। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৯ মার্চ বাদীর প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য নেয়া হয়নি। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের ১৫তম সাক্ষী মো. রমিজ উদ্দিন সাক্ষ্য দেন। এছাড়া ২০১৫ সালের ৭ মে বাদী অবশিষ্ট সাক্ষ্য দেন। বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্যের পর পুলিশ আর কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারেনি। ফলে রাষ্ট্রপক্ষ বারবার সময়ের আবেদন করছে। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ৯ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু বরাবরের মতো এদিনও সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় আদালত পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ৪ অক্টোবর ধার্য করেছেন।
জানতে চাইলে কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম হেলাল যুগান্তরকে বলেন, সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে আদালত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ নিচ্ছেন। সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষও সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সাক্ষীদের হাজিরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব স্থানে দফায় দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে। বারবার সমন পাঠানোর পরও মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনও সাক্ষ্য দেননি। পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, প্রধান বিচারপতি ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে বারবার পুরনো মামলা জট কমানোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এ মামলায় আদালত ও প্রসিকিউশন একাধিকবার সাক্ষী হাজির করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। অথচ সাক্ষী না আসায় মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আসছে না। দীর্ঘদিনের এ পুরনো মামলার বিচার কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ হওয়া উচিত।
৯ আগস্ট আদালত বলেন, চার্জশিটভুক্ত ৫১নং সাক্ষী পুলিশ পরিদর্শক মো. নুরুল আমিন (সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মোহাম্মদপুর থানা), ৫২নং সাক্ষী ডা. এজাজ আহম্মদ, ৫৩নং সাক্ষী ডা. আবদুল সামাদ, ৫৪নং সাক্ষী ডা. এফএম হাসান, ৫৫নং সাক্ষী অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. হাবিবুর রহমান, ৫৬নং সাক্ষী মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট এম আফজালুর রহমান, ৫৮নং সাক্ষী সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান ও মোহাম্মদপুর থানার তৎকালীন প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. তোফাজ্জল হোসেনকে উপস্থিত করতে অজামিনযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করা হল। তা তামিল করে সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করতে ঢাকার পুলিশ সুপার ও উপপুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হল। ১৩ আগস্ট আদালত থেকে এই আদেশের অনুলিপি অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার ও সহকারী পুলিশ কমিশনার বরাবর পাঠানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়িতে (টিনশেড বস্তি) কামালের গোলা পড়ে। লে. কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বস্তি। এতে নারী ও শিশুসহ ১৩ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে কয়েকজন পঙ্গুত্ববরণ করেন।
৪৩ বছর আগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেরশাহ সুরী রোডের ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত।
১৭ আসামির মধ্যে রয়েছেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। এছাড়া তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়া মামলার বাকি ১১ জন আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা। jugantor