আগুনে আকাশ তখন তাপ বিলিয়ে যাচ্ছে অকাতরে। গরমে পুড়ে যাচ্ছে সামারা এরেনা।
এরই মধ্যে ব্রাজিলকে নিয়ে গা গরমের অনুশীলনে আদেনর বাক্কি তিতে। কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচের আগে উন্মুক্ত অনুশীলনে তাও প্রথম একাদশকে আলাদা করেছিলেন। আক্রমণভাগের সম্মিলিতভাবে রক্ষণ করার দু-একটা ড্রিলও করান। কাল কিচ্ছুটি না।
মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচের প্রস্তুতির পুরোটাই যেন গোপন রাখতে চায় ব্রাজিল! প্রথম একাদশ বলতে গিয়েও তো সংবাদ সম্মেলনে কোচ তিতে সংশোধন দেন, ‘এটি বেসিক প্রথম একাদশ’।
এর ঘণ্টাখানেক আগের অনুশীলনে সামারা এরেনার মাঝ মাঠের গোলদাগে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে ব্রাজিলের ফুটবলারদের চোর-পুলিশ খেলা চলে কিছুক্ষণ। সামারা এরেনার সাইডলাইনের বাইরেও। গোলরক্ষক কোচ ক্লাউদিও তাফারেল তেকাঠির নিচে অনুশীলন করাচ্ছেন আলিসন, এদেরসনদের। তিতে নিজে গিয়ে ভিন্ন রঙের জ্যাকেট ধরিয়ে দেন অর্ধেক খেলোয়াড়ের হাতে; শুরুটা নেইমারকে দিয়ে।
হয়তো দুই দলে ভাগ করিয়ে ম্যাচ অনুশীলন করাবেন। মাঠের ভেতর ফিতা দিয়ে আরেকটি মাঠ সে জন্য তৈরি করে নিয়েছিল ব্রাজিল।
অনুশীলনে মার্সেলো ছিলেন। সতীর্থদের সঙ্গে গা গরমে কিংবা দৌড়াদৌড়িতে অস্বস্তিতে রয়েছেন বলে বোঝা যায়নি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক বাদের সংবাদ সম্মেলনে আজকের ম্যাচের প্রথম একাদশে অন্তত এই লেফট ব্যাকের খেলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন তিতে। এমনিতে গত চার-পাঁচ দিন অনুশীলন করেননি। তার ওপর সামারায় গরম পড়েছে যা; কাল তাপমাত্রা ৩৫-৩৬ ডিগ্রিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। এতে আবার ১২০ মিনিট খেলার সম্ভাবনা মাথায় রাখছে ব্রাজিল। ‘আমি অনুশীলনের পর মার্সেলোর সঙ্গে কথা বলেছি। ও বলেছে খেলতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের তো অনেকগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হয়। এমন কাউকে জেনেশুনে মাঠে নামাতে পারি না, যার কিনা পুরো ম্যাচ খেলার মতো ফিটনেস নেই’—বলেছেন ব্রাজিল কোচ তিতে।
দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে আজকের প্রতিপক্ষ নিয়ে ব্রাজিলের মাথা না ঘামালেও চলে! বিশ্বকাপে চার মুখোমুখিতে মেক্সিকোর কাছে কখনো হারবে কী, কোনো গোলই তো খায়নি সেলেসাওরা। সেটি মনে করিয়ে দেওয়া প্রশ্নে গা করেন না তিতে, ‘এগুলো পরিসংখ্যান। ব্রাজিল যেমন কখনো অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিততে পারেনি বলে রেকর্ড ছিল। ’ মেক্সিকোকে বরং সমীহই করছে ব্রাজিল। সেটি সর্বশেষ ছয় আসরে টানা তাদের এই শেষ ষোলোতে বাদ পড়ে যাওয়ার রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও। চলতি টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জার্মানিকে হারিয়েছে যে দল, তাদের হালকাভাবে নেওয়ার ভুল কিভাবে করে ব্রাজিল!
অথচ এ ম্যাচটি তো ব্রাজিল-জার্মানিও হতে পারত। গেলবারের ১-৭ গোলে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ থাকত তাহলে। এসব নিয়ে পড়ে থাকতে রাজি নন থিয়াগো সিলভা, ‘ইতিহাস নিয়ে আমরা ভাবছি না। আর এগুলো বদলানোও যাবে না। অন্যতম ফেভারিট হিসেবে এসে জার্মানি যেমন বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে গেছে। আর্জেন্টিনা-পর্তুগালও। আমরা এসব নিয়ে না ভেবে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচে মনোযোগ দিচ্ছি কেবল। ’ সে খেলায় দলের কাছে কোচ তিতের প্রত্যাশা স্পষ্ট, ‘সার্বিয়ার বিপক্ষে গত ম্যাচে দক্ষতা-কৌশল-আবেগ-শরীরিক দিক দিয়ে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছি, আমাদের এরও ওপরে উঠতে হবে। ’
প্রত্যাশার সে জায়গাটা নেইমারের কাছেও থাকবে নিঃসন্দেহে। সামারা এরেনায় ১৫ মিনিটের অনুশীলনে খুব চনমনে দেখায়নি তাঁকে। বরং মনোযোগী মনে হয়েছে অনেক বেশি। লিওনেল মেসি, ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর তারকাকূলে বৃহস্পতি হওয়ার সুযোগ তো ভালোমতোই তাঁর সামনে। আর প্রতি ম্যাচে নেইমারের পারফরম্যান্সে উন্নতিও হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। সমালোচকরা তাতে তুষ্ট না হলেও কোচ তিতে তৃপ্ত, ‘নেইমার দুর্দান্ত খেলছে। উইঙ্গারদের সাহায্য করছে, খেলার ধারা বদলে দিচ্ছে, আক্রমণ শেষ করছে। মেক্সিকোর বিকপক্ষে ও কেমন খেলবে, জানি না। কিন্তু এই তিন ম্যাচের সব তথ্য পর্যবেক্ষণ করে তো দেখেছি, সতীর্থদের চেয়ে ও এগিয়ে আছে। তবে অবশ্যই আরো খেলার সামর্থ্য ওর রয়েছে। ’
সামর্থ্যের দিক দিয়ে মেক্সিকো যে পিছিয়ে নেই, জার্মানিকে হারিয়ে এর প্রমাণ এক দফা দিয়েছে তারা। তবে দুর্ভাগ্য যে দুই কার্ডের কারণে আজ সেন্টারব্যাক হেক্তর মোরেনোকে পাচ্ছে না। মুখোমুখি রেকর্ডেও অনেক এগিয়ে ব্রাজিল। বিশ্বকাপের চার খেলার মধ্যে তিন জয় তাদের; বাকিটি ড্র। আর সব মিলিয়ে ৪০ লড়াইয়ে ব্রাজিলের ২৩ জয়, মেক্সিকোর ১০। পরিসংখ্যানের আরেক জায়গায়ও উজ্জীবনী রয়েছে সেলেসাওদের। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সর্বশেষ ছয় হার ইউরোপিয়ান দলের বিপক্ষে। সর্বশেষ অইউরোপীয় দলের কাছে হেরেছে তারা ১৯৯০ সালে; আর্জেন্টিনার কাছে। সেবারের পর অন্তত কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত ব্রাজিল গিয়েছে প্রতিবার।
টানা ছয়বার কোয়ার্টারের ঠিক আগের গণ্ডিতে আটকে যাওয়া মেক্সিকো আজ ব্রাজিলকে হারিয়ে দেবে—এ পক্ষে বাজি ধরার লোক বরং।
ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ বরং তারা নিজেরাই। বিশ্বকাপের তিন ম্যাচে উন্নতির ধারাবাহিকতা আজও ধরে রাখা। পায়ে পায়ে সৌন্দর্যের ফুল ফোটানো; সাম্বার সুর তোলা। সামারা এরেনার আগুনে গরমে আজ ফুটবলভক্তদের মনে আগুনের পরশমণি ছোঁয়ানোর অভিযানেই নামবে ব্রাজিল। সঙ্গে জয়টাও তো চাই-ই চাই!