আভা ডেস্ক: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ট্রাক উল্টে পাঁচজন নিহত। আজ সোমবার বেলা পৌনে ১১টার টাটকা খবর এটা। দুর্ঘটনার খবর এখন একেবারে ডালভাত। ঘটনা ঘটে, খবর রটে, আমরা কপ করে গিলে ফেলি। হজম হয়ে যায়। চেনাজানা কেউ ঘটনার মধ্যে না থাকলে এ ধরনের ঘটনাকে আজকাল বেশির ভাগ মানুষ আমল দেয় না। অনুভূতি মিশেল।
আমিত্বসর্বস্ব নগরজীবনে তা এ রকম—আমার তো কিছু হয়নি বা আমার তো কিছু যায়-আসে না। তা ছাড়া রকেটগতির ধাবমান জীবনে এ নিয়ে পড়ে থাকার সুযোগই-বা কোথায়। সারা দিনে গোটা দুনিয়ায় কত কিছুই না ঘটে, এত সব আমল দেওয়ার ফুরসত তো নেই। এরপরও কিন্তু ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
একটি জীবন তো কেবল একজনেরই একক জীবন নয়; এর সঙ্গে অনেকেরই জীবন বাঁধা। কাজেই একটি জীবন বিচ্ছিন্ন হলে অন্য জীবনে এর প্রভাব পড়ে। বেদনা ভার চাপে জগদ্দল পাথরের মতো। অসুখ-বিসুখে মৃত্যুর মধ্যে ব্যথা-যন্ত্রণা-শোক যতই থাকুক, একটি প্রস্তুতির ব্যাপার থাকে। সময় থাকে মৃত্যু মেনে নেওয়ার। যিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন, তিনিও বলে যেতে পারেন অনেক অজানা বিষয়, করে যেতে পারেন কিছু সুষ্ঠু সমাধান, যা জগৎ-সংসারে আপনজনদের আর্থিক ও মানসিকভাবে সমর্থন জোগায়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মতো মর্মন্তুদ ঘটনা হঠাৎ করেই আপাদমস্তক একটা সুস্থ মানুষকে যেভাবে নেই করে দেয়, এই আকস্মিক আঘাত মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। আমাদের দেশে উৎসব আর পালাপার্বণে ঘরমুখী মানুষের ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা সড়ক, রেল আর নৌপথে যাত্রীদের ঢল নামায়, এর জের ধরে দুর্ঘটনা কম ঘটে না। আবার ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফেরার সময়ও বিপুল রাশ থাকে। আর তখন একই রকম দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যায়। গত শনিবার ছিল এমন একটি দিন।
ওই যে কথায় বলে—শনির দশা! গেল শনিবার দেশের কয়েকটি সড়কপথে সত্যিই যেন শনি লেগে ছিল। এক দিনেই ঝরে গেল অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণ। ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় শিরোনাম ছিল—‘ডেডলিয়েস্ট ডে ফর ট্রাভেলার্স’। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে তা এক ভয়াবহতম দিন। খবরে নিহত মানুষের সংখ্যা ৫২ উল্লেখ করা হয়। অন্যান্য পত্রিকার খবরে কোনোটিতে নিহত মানুষের সংখ্যা ৪২, কোনোটিতে-বা ৪৫ জন উল্লেখ করা হয়। এক গাইবান্ধায়ই মারা গেছে ১৮ জন।
১৬ কোটি মানুষের দেশে অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা আকারে বিন্দুবৎ তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু যার যায়, সে বোঝে আপনজন হারানোর যাতনা। আর প্রাণ খোয়ানো মানুষটি যদি সংসারের হাল ধরা কান্ডারি হন, তবে তো সাড়ে সর্বনাশ! তিনি তো মরলেনই, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভাড়া মরণের খাতায় নাম লিখিয়ে গেলেন।
আমি তেমনই এক ঘরপোড়া গরু। মাত্র সাত বছর বয়সে বাবাকে হারাই। এক শিশুর স্মৃতিপটে তা ছিল আগুন-পোড়া সিলমোহর। তরতাজা সুবেশ মানুষটি বিকেল দিব্যি বেরিয়ে গেলেন, পরদিন সকালে দেখতে পেলাম মর্গফেরত লাশ। আমার মা যে চিৎকারটা দিয়েছিলেন, তা এখনো আমার মর্মমূলে বাজে। কত যে দুঃস্বপ্ন দেখেছি, হিসাব নেই। কেউ যখন আমাকে ‘এতিম’ বলে ট্রিট করত, মনে হতো দুনিয়ার অন্য সব শিশুর চেয়ে আমি আলাদা। এখনো দূরযাত্রার গাড়িতে ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করি। রাস্তা পার হতে ভয় লাগে। এই মানসিক চাপ রয়েই গেছে। এভাবে একটি মানুষের মৃত্যু জীবনভর আপন কারও মর্মপীড়া বা মানসিক সমস্যার কারণ হতে পারে। এতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে নানাভাবে।
নিজেকে দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো অন্যদের দুরবস্থা টের পাই। দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে হাত হারিয়ে না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া রাজীবের দুই শিশু সহোদরের অন্তরের জ্বালা যে কী, তা আমি জানি। বেপরোয়া গতির বাসের চাপায় নিহত ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী নাজিম উদ্দিনের পরিবার কী হারিয়েছে, তা আমি উপলব্ধি করতে পারি।
এই ক্ষতি আসলে কোনো কিছুতেই পূরণ হয় না। সারাটা জীবন ভোগায়। কিন্তু এই দুর্ঘটনা রোধে বাস্তবে কঠোর কোনো পদক্ষেপ এবং ব্যাপক সচেতনতা নেই। ঘটনা অনেকটা ‘সরকার কি মাল, দরিয়া মে ঢাল’-এর মতো। দেশে এত মানুষ এত প্রাণ, সড়কে করে দে অকাতরে দান—ঘটনাগুলো যেন এ রকমই। গত এপ্রিলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৪৩৪ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় চার হাজার মানুষ মারা গেছে। গবেষণা বলছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তরুণ ও কর্মক্ষম মানুষই বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণা অনুসারে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ হারানো মানুষের বেশির ভাগের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছর। এতে সুস্পষ্ট যে দেশের জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ সড়ক দুর্ঘটনায় জীবন দিচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন সড়কপথে অহরহ দুর্ঘটনা কেন ঘটছে, তা বলা বা দেখার জন্য বিশেষজ্ঞের দরকার নেই। খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোর চেহারাই তা বলে দেয়। এর সঙ্গে কারণ হিসেবে রয়েছে ফিটহীন গাড়ির রুট পারমিট, অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো, আর ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরিগুলোর বেপরোয়া গতি।
শনি ও সোমবারের প্রতিটি দুর্ঘটনায় ট্রাক জড়িত। নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে অতিরিক্ত মালামাল বহন এবং চালকের ক্লান্তিহীন একটানা গাড়ি চালনাই মূলত ট্রাকগুলোকে দুর্ঘটনায় জড়িত করছে। এ ব্যাপারে আদৌ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যাত্রীবাহী বাসগুলোর ক্ষেত্রেও অনেক চালক মালুমই করেন না যে একগাদা মানুষের জীবন তাঁর স্টিয়ারিং হুইলে বাঁধা—একটু নিয়ন্ত্রণ হারালেই ঘটবে ব্যাপক প্রাণহানি। আর বাস-ট্রাকের বেশির ভাগ মালিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়ায় ও রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে থাকায় চালকদের গা-ছাড়া একটা ভাব থাকে—দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলেও তাঁর কিছুই হবে না।
ঈদ-পরবর্তী ফাঁকা রাস্তায় গত মঙ্গলবার সেলিম নামের এক পথচারীকে মেরে পালিয়ে গিয়েছিল নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরীর স্ত্রীর মালিকানাধীন গাড়িটি। ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত দুজন বলেছেন, সাংসদের ছেলে শাবাব চৌধুরীই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। টাকা-পয়সা দিয়ে এ ব্যাপারে আপস-রফার চেষ্টা চলছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
এখানে আশার কথা এই যে দূরপাল্লার যানে বিকল্প চালক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অন্য সব নির্দেশের মধ্যে রয়েছে পরিবহনের চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, রাস্তার মাঝে চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা, সিগন্যাল দিয়ে পারাপার করা, সিট বেল্ট পরানো নিশ্চিত করা। আজ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী এসব নির্দেশ দেন। আমরা চাইব, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ কেবল আশার আলো হয়েই থাকবে না, সে আলো সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নতুন পথ দেখাবে। আমাদের সামনে আর এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাবে না—জীবনের দাম কত?
উৎস
প্রথম অালো