আভা ডেস্কঃ রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের কাটছাঁটের মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের (২০১৮-২০১৯) সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আকার দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ব্যয় কমানো হল ২২ হাজার ২৬ কোটি টাকা। ব্যয় করার সক্ষমতার অভাবেই মূলত বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছে ২২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ৩০ জুন জাতীয় সংসদে এর অনুমোদন দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে চলতি বাজেট সংশোধনের প্রস্তাব আনা হয়। বিস্তারিত পর্যালোচনার পর ওই বৈঠকে এটি চূড়ান্ত করা হয়।
বৈঠকে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাতে কর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ কমছে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধির গতি না বাড়লে সরকারের ব্যয় আশানুরূপ বাড়ানো যাবে না।
সরকারের ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি ওই বৈঠকে আরও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের মতো বড় ঘটনার পরও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালকদের অর্থছাড়ের আদেশ গ্রহণের মতো বিধান বাতিল করায় অর্থছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে। কারণ প্রকল্প পরিচালকরা নিজ ক্ষমতাবলে বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করতে পারছেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।
শেষ পর্যন্ত তা কাটছাঁট করে সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত করা হয় ৩ লাখ ১৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছিল ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা।
যদিও রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রাক?-বাজেট বৈঠকে ঘোষণা দিয়েছিলেন- এবার সরকারের রাজস্ব আদায়কারী এই সংস্থার (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা কমানো হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তার অবস্থানে অটল থাকতে পারলেন না। অবশ্য এর কারণও আছে।
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস জুলাই-মার্চে রাজস্ব আদায়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি দেখা গেছে। এই সময়ে শুল্ক, কর ও ভ্যাট মিলিয়ে মোট রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।
বাজেট কাটছাঁট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এটি দেশের ঐতিহ্য হয়ে গেছে।
নিয়ম অনুযায়ী বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকবারই কাটছাঁট করে ছোট করা হয়। এছাড়া প্রকৃত বাজেট বাস্তবায়নে দেখা গেছে আরও কম হয়। এর কারণ হচ্ছে অতি উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিবিদরা মনে করেন বড় বাজেট দিতে পারলে বাহবা পাওয়া যাবে। কারণ এই বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সাধারণ মানুষ মাথা ঘামায় না। তিনি মনে করেন, বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট ঘোষণার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।
সূত্রমতে, চলতি বাজেটে রাজস্ব কর আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত এ খাত থেকে ১৬ হাজার ২৭০ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
নতুন সংশোধিত রাজস্ব করের লক্ষ্যমাত্রা হয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬০ কোটি টাকা।
এদিকে গত ১৩ মে রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়াতে প্রথমবারের মতো এনবিআরের পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি চলতি মে ও আগামী জুনের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি তদারকি করবে।
বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়টি মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করা দরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর বাজেটে শুধু ব্যয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আয়কে চাপের মুখে ফেলা হচ্ছে।
এতে পুরো বাজেট প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে। সেদিক বিবেচনা করে আয়ের লক্ষ্যমাত্রার সাপেক্ষে ব্যয় নির্ধারণ করা দরকার। তাহলেই বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে। অন্যথায় প্রতিবার এ ধরনের কাটছাঁট করায় পুরো প্রক্রিয়ায় একধরনের প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এবং বাজেট প্রণয়নে দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে।
সূত্রমতে, বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নের আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ। চলতি বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকিং খাত থেকে ৪২ হাজার ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু সংশোধিত বাজেটে এ খাত থেকে ১১ হাজার ১২২ কোটি টাকা কম নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাত থেকে ঘাটতি পূরণে শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা নেয়া হবে।
যদিও অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের মতে, সংশোধিত বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে যে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি নেয়া হবে না। কারণ সরকার অপর একটি খাত সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, চলতি বাজেটে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রাও কাটছাঁট করা হয়েছে। ৫৪ হাজার ৭০ কোটি টাকা শুরুতে সহায়তা নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ খাত থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪৭ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ বৈদেশিক সহায়তা কাটছাঁট করা হয় ৬ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিশ্রুতি বেশি থাকলে বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যয়ের সক্ষমতা কম থাকায় সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে।
যুগান্তর