আভা ডেস্ক
নগরীর বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালে শিশু রাফিদা খান রাইফার মৃত্যুতে চিকিৎসকদের অবহেলা ও গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ চার দফা সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এদিকে, রাইফার চিকিৎসার সময় হাসপাতালটির নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্রও উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিবেদনটি জমা দেয়। তবে শুক্রবার তা প্রকাশ করা হয়।
সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, সাংবাদিক ও চিকিৎসকদের সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করেছে। দুই পেশাজীবী নেতাদের কাছে প্রতিবেদন পৌঁছে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের একটি কপি স্বাস্থ্য অধিদফতরেও পাঠানো হবে। প্রতিবেদনে চিকিৎসায় অবহেলা ও গাফিলতির কারণে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ডা. বিধান রায় চৌধুরী, ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। নগরীর মেহেদীবাগ এলাকার ম্যাক্স হাসপাতালে ২৮ জুন সাংবাদিক রুবেল খানের আড়াই বছরের মেয়ে রাইফাকে ভর্তি করা হয়। গলায় ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। এরপর পরিবার ও সাংবাদিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাইফার মৃত্যুর পরদিন চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক সবুর শুভ।
তদন্ত প্রতিবেদনে যা আছে : তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাইফা তীব্র খিঁচুনিতে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। চিকিৎসকের অনভিজ্ঞতায় রাইফার অবস্থা আরও খারাপ হয়। তবে সংশ্লিষ্ট নার্সদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও এমন জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা বা জ্ঞান তাদের ছিল না। ম্যাক্স হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাইফার ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে শেষ চিকিৎসা পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের ভোগান্তি ছিল চরমে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরী শিশুটিকে যথেষ্ট সময় ও মনোযোগসহকারে পরীক্ষা করে দেখেননি। শিশুটির চরম অসুস্থতার মুহূর্তে ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেব আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেননি। শিশুটির পিতা-মাতার অভিযোগ তিন চিকিৎসকের বেলায় সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, হাসপাতালে রোগী ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভোগান্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসক-নার্সদের সেবা প্রদানের সমন্বয়হীনতা ও চিকিৎসাকালীন মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। অনভিজ্ঞ চিকিৎসক ও অদক্ষ নার্স নিয়োগ দেয়ায় হাসপাতালের কাক্সিক্ষত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অনেক দুর্বল। বিশেষত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবায় বিশেষজ্ঞের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির সংকটটি প্রবল।
তদন্ত প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, ম্যাক্স হাসপাতালের সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা দ্রুত সংশোধন করা। এ ছাড়া কর্তব্যরত নার্স সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ডিপ্লোমাধারী থাকার নিয়ম থাকলেও ম্যাক্স হাসপাতালে তা নেই। ডিপ্লোমাধারী নার্স দ্বারা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক দ্রুত ও আন্তরিক সেবা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং রোগীর অভিভাবককে যথাসময়ে রোগীর অবস্থা ও চিকিৎসার ব্যাপারে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবগত করতে হবে।
সাংবাদিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া : তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা। তারা বলেন, সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি রাইফার চিকিৎসায় অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিদর্শন দলও ম্যাক্স হাসপাতালের ১১টি অনিয়ম চিহ্নিত করেছে। দুটি প্রতিবেদন পড়লেই বোঝা যায় রাইফার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। সাংবাদিক নেতারা বলেন, এখন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে অবৈধ ম্যাক্স হাসপাতাল বন্ধ, রাইফা হত্যার বিচার ও জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিইউজের সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস। সংগঠনের সভাপতি নাজিমুদ্দীন শ্যামলের সঞ্চালনায় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি শহীদ উল আলম, সিইউজের সাবেক সভাপতি এজাজ ইউসুফী, মোস্তাক আহমদ, রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সহ-সভাপতি মনজুর কাদের মনজু, সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব তপন চক্রবর্তী, সিইউজের যুগ্ম সম্পাদক সবুর শুভ প্রমুখ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিএমইউজে) অভিযুক্ত চিকিৎসকদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানিয়েছে। শুক্রবার সকালে সিএমইউজে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা বলেন, দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে শিশু রাইফার মৃত্যু হয়েছে। জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেয়া ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে চলমান আন্দোলন ভিন্ন খাতে নেয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তারা বলেন, প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। নগরীর নুর আহমদ সড়কে সিএমইউজে মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সিএমইউজে সভাপতি শামসুল হক হায়দরী। এতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক সমবায় সমিতির (চমেসাস) সভাপতি মো. ইসকান্দর আলী চৌধুরী, বিএফইউজের সাবেক সহ-সভাপতি জাহিদুল করিম কচি, সিএমইউজের সহ-সভাপতি মুস্তফা নঈম, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, চমেসাসের সহ-সভাপতি সালেহ নোমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
বুধবার চিকিৎসকদের গোপন সমাবেশে ড্যাব নেতা ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরীর উসকানিমূলক বক্তব্য ও নির্লজ্জ মিথ্যাচারের বিষয়ে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়ে সাংবাদিকরা বলেন, অন্যথায় সাংবাদিক সমাজ এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হবে।
যুগান্তর