আভা ডেস্ক :মৃত্যুপুরীতে সাক্ষাৎ যমের সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে জয় করেই ফিরছে থাই কিশোররা। গুহায় আবদ্ধ টানা ১৬ দিনের গুমোট পরিবেশ থেকে সোনালি আলোয় বেরিয়ে আসছে তারা।
ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলছে কিশোর ফুটবলাররা। গত দু’দিনে একে একে মৃত্যুঞ্জয়ী ৮ কিশোর মুক্ত দুনিয়ার মুখ দেখেছে। সবার চোখে-মুখে উল্লাস-উৎসবের আমেজ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে পুরো থাইল্যান্ড।
সোমবার দ্বিতীয় দিনের অভিযানে গুহায় আটকে পড়া আরও চার কিশোরকে বের করে আনেন উদ্ধার কর্মীরা। রাত হয়ে যাওয়ায় আবারও অভিযান স্থগিত করা হয়। এখন কোচসহ গুহায় রয়েছে আরও ৫ জন। খবর এএফপি, বিবিসি ও সিএনএনের।
রোববার প্রথম দিনে উদ্ধার অভিযান শেষে চার কিশোরকে উদ্ধার করা হয়। সোমবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টার দিকে দ্বিতীয় দিনের অভিযান শুরু হয়। রোববারের সেই ১৮ ডুবুরিই আবার গুহায় প্রবেশ করেন।
স্থানীয় সময় সাড়ে ৪টার দিকে পঞ্চম কিশোরকে গুহা থেকে বের করে আনেন উদ্ধারকারীরা। এরপর আরও তিনজনকে গুহা থেকে বের করে আনেন উদ্ধারকারীরা। এখনও চার ফুটবলার ও কোচ গুহার ভেতরে আছেন।
উদ্ধারের পরই অ্যাম্বুলেন্সে তাদের চিয়াং রাই প্রদেশের প্রাচ্যানুকরোহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে রোববার উদ্ধার হওয়া চার কিশোর। উদ্ধারকারীরা জানান, কিশোর ফুটবলাররা সুস্থ আছে। তাদের চিকিৎসা চলছে।
উদ্ধার কাজে ব্যাঘাত ঘটার শঙ্কায় গুহা এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করেন থাই প্রধানমন্ত্রী প্রায়ুত চান-ওঁচা। সোমবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে গুহা এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল তার।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দ্বিতীয় দফায় উদ্ধার করা কিশোরদের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। এদিন সকালে সংবাদ সম্মেলনে চিয়াং রাইয়ের গভর্নর নারংসাক ওসোত্তানাকর্ন বলেন, প্রথম ধাপে উদ্ধার হওয়া চার কিশোর সুস্থ রয়েছে। সংক্রমণের ভয়ের কারণে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। তবে দূর থেকে হাসপাতাল কক্ষের কাচের বাইরে থেকে দেখা করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ থাম লুয়াং থাইল্যান্ডের দীর্ঘতম গুহা। গত ২৩ জুন চিয়াং রাই প্রদেশের ওই গুহায় ঢোকার পর নিখোঁজ হয় ওই ১৩ জন। ১২ কিশোরের একজনের জন্মদিন উদ্যাপন করতে ও বেড়াতে তারা সেখানে গিয়েছিল।
মু পা (ওয়াইল্ড বোয়ার্স) নামের ফুটবল দলটি বৃষ্টির পানি বাড়তে থাকায় গুহার ৪ কিলোমিটার দূরে চলে যায়। নিখোঁজের ৯ দিন পর ২ জুলাই ব্রিটিশ ডুবুরি রিচার্ড স্ট্যানটন ও জন ভলানথেন তাদের সন্ধান পান। তাদের অবস্থান জানার পর গুহার ভেতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করার পাশাপাশি পাঠানো হয় খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। গত শুক্রবার কিশোরদের অক্সিজেন সরবরাহ করে ফেরার পথে প্রাণ হারান থাই নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি সামান কুনান।
নেভি সিলের অবসরপ্রাপ্ত এ সদস্য মারা যান অক্সিজেন-স্বল্পতায়। শনিবার অস্ট্রেলিয়ার এক চিকিৎসক গুহায় ঢুকে কোচ ও কিশোরদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে উদ্ধার অভিযান শুরু করার সবুজ সংকেত দেন।
বৃষ্টির চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে গুহায় আটকে পড়া ১৩ জনকে উদ্ধারে রোববার সকাল থেকে মূল অভিযান শুরু হয়। রোববার চার কিশোরকে উদ্ধার করার পর উদ্ধার অভিযানে প্রায় ১০ ঘণ্টার বিরতি দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দিনের অভিযান শেষেও মঙ্গলবার (আজ) সকাল পর্যন্ত অভিযান স্থগিত করা হয়েছে।
পুরো উদ্ধার প্রক্রিয়ায় ৯০ জনের একটি ডুবুরি দল কাজ করছে। তাদের মধ্যে ৪০ থাইল্যান্ডের ও ৫০ জন বিদেশি। গুহায় প্রবেশ করে মূল অভিযানে অংশ নেন ১৩ বিদেশি ও থাই নেভি সিলের ৫ ডুবুরি।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে, কাদা মাড়িয়ে, কখনও চড়াইয়ে উঠে, আবার কখনও পানির নিচ দিয়ে সাঁতরে ওই কিশোরদের বের করে আনা হয়। উদ্ধার কাজের জন্য বাইরে থেকে ওই ফুটবল দলের অবস্থানস্থল পর্যন্ত দড়ি বাঁধা হয়।
উদ্ধারের সময় প্রত্যেক কিশোরকে অক্সিজেন মাস্ক পরানো হয়, দড়ি দিয়ে বাঁধা হয় সামনে থাকা ডুবুরির সঙ্গে। তিনি গুহায় বাঁধা দড়ি ও কিশোরের অক্সিজেনের বোতল নিয়ে অগ্রসর হন। কোনো সমস্যা হলে সহায়তার জন্য পেছনে ছিলেন আরেক ডুবুরি।
গুহার সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গাটি ‘টি-জংশন’ নামে পরিচিত। এ এলাকা এতটাই সংকীর্ণ যে এখানে ডুবুরিদের অক্সিজেন ট্যাংকও খুলে ফেলতে হয়। এ এলাকার আগে ‘চেম্বার-থ্রি’ নামের প্রকোষ্ঠে বেজ ক্যাম্প বানানো হয়েছে। সর্বশেষ ধাপটি অতিক্রমের আগে এখানে কিছু সময় বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখা হয়।
উদ্ধার অভিযানের শুরু থেকে গুহার বাইরে অবস্থান নেয় ১৩টি চিকিৎসক দল। ১৩ জনের প্রত্যেকের জন্য একটি করে দল। প্রতি চিকিৎসক দলে রয়েছে একটি করে হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুলেন্স।
গুহা থেকে বের করে আনার পরপরই ওই ১৩ জনের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তারপর তাদের হেলিকপ্টারে করে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চিয়াং রাই প্রাচ্যানুকরোহ হাসপাতালে নেয়া হয়। উদ্ধারকারী দলে যোগ দেন দেশি-বিদেশি ১ হাজার জন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ। থাইল্যান্ডে এরকম গুহার মধ্যে আটকে পড়ার ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটে। তবে গুহার এত গভীরে একসঙ্গে এতজন আটকে পড়ার ঘটনা আগে ঘটেনি।
যুগান্তর