ভোরের আভা ডেস্ক: অস্বাভাবিক ব্যাংক লেনদেন, মানি লন্ডারিং ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার দুদক কার্যালয়ে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. সামসুল আলম। দুদকের গণসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
চেয়ারম্যান থাকার সময় বাচ্চু তার স্ত্রী শেখ শিরিন আখতার, পুত্র শেখ সাবিদ হাই অনিক ও মেয়ে শেখ রাফা হাইকে সঙ্গে নিয়ে খুলেছিলেন ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান।
এ প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১১ মাসেই জমা হয় ১৩ কোটি টাকার বেশি। এ টাকার উৎস কি? বেসিক ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সময় নেয়া কমিশনের টাকা এই ব্যাংক হিসাবে রাখা হয় কিনা- এমন অসংখ্য প্রশ্ন করা হয় বাচ্চুকে।
তবে তিনি দুদক কর্মকর্তার প্রশ্নের জবাবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, ওই টাকা তার ব্যবসার। ব্যবসার লেনদেনের বিষয়টি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টেক্স ফাইলে দেখানো আছে বলে দাবি করেন তিনি।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে ঘুরেফিরে সেই বেসিক ব্যাংকের প্রসঙ্গই আসে। দুদকের কর্মকর্তা জানতে চান তিনি (বাচ্চু) বেসিক ব্যাংকের দায়িত্ব নেয়ার আগে তার কোনো ব্যবসা ছিল কিনা বা ইডেন ফিশারিজ নামে যে প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে- তার কার্যক্রম কখন শুরু হয়।
জাববে বাচ্চু বলেন, তিনি আগে থেকেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে পরে। তবে তার মেয়াদকালে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে তিনি তেমন কিছু বলেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চেয়ারম্যান থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। বেসিক ব্যাংকে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ঋণের জন্য আবেদন করেছিলেন তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বাচ্চু ও ভাইসহ স্বজনদের হিসাবে রেখেছেন- এমন একটি অভিযোগ দুদকের নজরে এলে পৃথক অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
একই অভিযোগে তার স্ত্রী শিরীন আক্তার, এক ছেলে এক মেয়ে ও ৭ ভাই-বোনসহ পরিবারের ১১ সদেস্যর ব্যাংক হিসাব তলব করে সংস্থাটি। তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পরই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে।
বাচ্চু ছাড়াও তার পরিবারের অন্য যে ১০ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে দুদক তাদেরও তলব করে জিজ্ঞাসাবাদের চিন্তাভাবনা করছে বলে জানা গেছে। বাচ্চু ও তার স্ত্রী ছাড়াও অনুসন্ধানের আওতায় আছেন তার ছেলে শেখ ছাবিদ হাই অনিক ও মেয়ে শেখ রাফা হাই, ভাই শেখ ওয়াহিদুজ্জামান, শেখ খালেকুজ্জামান, শেখ শাহরিয়ার পান্না, শেখ জনি, বোন শেখ সাদিয়া বুলু, শেখ মমতাজ রুমি ও শেখ শিউলি আক্তার।
এর বাইরে বাচ্চু ও তার পরিবারের তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। এগুলো হল- ইডেন ফিশারিজ লিমিটেড, ক্রাউন প্রোপার্টিজ ও বিএম কম্পিউটার্স।
বাচ্চু ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠান- ইডেন ফিশারিজ লিমিটেডের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১১ মাসেই জমা হয় ১৩ কোটি টাকা। এ ঘটনা ছাড়াও ২০১২ ও ২০১৩ সালে কয়েক মাসের ব্যবধানে বাচ্চু ও তার ভাই পান্নার ব্যাংক হিসাবে ৩০ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমার প্রমাণ পেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন টিম।
বাচ্চু ও তার ভাইয়ের ব্যাংক হিসাব বিবরণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। এ ঘটনায় বাচ্চুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২০১৪ সালে দুদকের কাছে অনিয়মের দালিলিক তথ্য পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু দুদক তখন চুপ ছিল।
সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে বাচ্চুর ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে এলে দুদক অনুসন্ধানে মাঠে নামে।
এদিকে দুদক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন, অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধানের স্বার্থে প্রয়োজনে বাচ্চুকে ফের তলব করতে পারে দুদক। অন্যদিকে বেসিক ব্যাংকের ৫৬ মামলায় তার ‘দায় নির্ণয়’ করতে তদন্ত চলমান রয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের মামলায় তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানান। প্রসঙ্গত, আবদুল হাই বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়।
কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করার পর চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন। পরে বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তদন্তে বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এর মধ্যে ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় মামলা করে দুদক।
যার মধ্যে রয়েছে- গুলশান শাখার মাধ্যমে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখায় ৩৮৭ কোটি টাকা, প্রধান শাখায় প্রায় ২৪৮ কোটি টাকা এবং দিলকুশা শাখায় ১৩০ কোটি টাকা।