আভা ডেস্কঃ বিদায়ী বছরে চট্টগ্রাম বন্দর বেশকিছু মাইলফলক অর্জন করলেও প্রতিষ্ঠানটির সেবা নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। বছরের মাঝামাঝি সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে এক লাফে ছয় ধাপ এগিয়ে বিশ্বের ১০০ বন্দরের মধ্যে ৬৪তম স্থানে উঠে আসে এই সমুদ্র বন্দর। আর বছরের শেষদিকে ৩০ লাখ কনটেইনার পরিবহনের কোটা পূর্ণ করে ঠাঁই করে নেয় ‘থ্রি মিলিয়ন ক্লাবে’। এতকিছুর পরও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে প্রত্যাশিত গতি আসেনি। বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, এখনও বার্থিং পেতে বহির্নোঙরে জাহাজকে বেশ কয়েকদিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নানা উদ্যোগের ফলে জাহাজের অপেক্ষার সময় আগের চেয়ে অনেকটাই কমে এসেছে। কনটেইনারবাহী জাহাজ ২-১ দিনে বার্থিং পাচ্ছে। খোলা পণ্যবাহী জাহাজকে ৪ থেকে ৫ দিন বহির্নোঙরে অবস্থান করতে হচ্ছে।
এদিকে বিদায়ী বছরে বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন আগের বছরের চেয়ে বাড়লেও প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। ফলে সাফল্যের সঙ্গে আছে হতাশাও। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৭ টিইইউএস (টুয়েটি ফিট ইকুইভিলেন্ট ইউনিটস) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এর আগের বছর (২০১৮) হ্যান্ডলিং হয়েছিল ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ টিইইউএস। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। তবে আগের বছর কনটেইনারে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার ৭৩৬ মেট্রিক টন যেখানে আগের বছর হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৯ কোটি ৬৩ লাখ ১১ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর জাহাজের আগমনে প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়েছে ১ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ এসেছিল ৩ হাজার ৭৪৭টি আর ২০১৯ সালে এসেছে ৩ হাজার ৮০৭টি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট এএম মাহবুব চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বন্দর থ্রি মিলিয়ন ক্লাবে গেছে। এর ৯৯ শতাংশ দাবিদার হল বিজিএমইএ। বন্দর দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিং হয় তার ৮০ শতাংশই বিজিএমইএ’র। কিন্তু এখনও বহির্নোঙরে জাহাজকে পণ্য নিয়ে ৭-১০ দিন অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। মাল নামানোর পর বুঝে পেতে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগছে। তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রেতা চলে যাচ্ছে। গত বছর ৬০০ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। এ সেক্টরে ১৯ শতাংশ রফতানি কমেছে। বন্দর প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছে না। আউটারেই যদি জাহাজকে ১০ দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে প্রত্যাশিত সেবা কিভাবে পাওয়া যায়? আমরা চাই একদিনে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস হোক। ভিয়েতনাম একদিনে মাল বুঝে পায়। আমাদের পণ্যের জন্য দিনের পর দিন বসে থাকতে হয়।
বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নও সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। তিনি বলেন, ‘বে-টার্মিনাল না হলে বন্দর প্রবৃদ্ধি সামাল দিতে পারবে না। ১৫ বছর ধরে বে-টার্মিনালের কথা শুনে আসছি। এখনও পর্যন্ত প্রকল্পটি একচুলও এগোয়নি। যেটা ২০২১ সালে হওয়ার কথা সেটা ২০৪১ সালেও হয় কিনা সন্দেহ আছে।’
চট্টগ্রাম বন্দর কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অগ্রগতি অর্জন করলেও যে হারে রফতানি বাড়ছে, সেই হারে বন্দর এগোচ্ছে না বলে মনে করছেন বিজিএমইএ’র সহসভাপতি এএম চৌধুরী সেলিম। তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ব্যবসার ক্ষেত্রে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্দর থেকে পণ্য বুঝে পেতে সময় লাগছে। এটা কাম্য নয়। আজকে আসা পণ্য আজকে ডেলিভারি দিতে হবে। কাঁচামাল যথাসময়ে বুঝে না পেলে আমরা সঠিক সময়ে রফতানি করতে পারি না। এতে অর্ডার বাতিল হয়। কখনও কখনও জাহাজ ২-১ দিনেও বার্থিং পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইয়ার্ড থেকে পণ্য ডেলিভারি পেতে দেরি হচ্ছে। বন্দরকে আরও গতিশীল হতে হবে।’ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, গত কয়েক বছরে পণ্য হ্যান্ডলিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর অগ্রগতি অর্জন করেছে। গ্যান্টি ক্রেনসহ বেশকিছু হ্যান্ডলিং সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। বন্দরের ইয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে। জাহাজের ওয়েটিং টাইম এখন অনেক কমে এসেছে। কনটেইনার জাহাজ ১-২ দিনে জেটিতে বার্থিং পেয়ে যাচ্ছে। তবে জাহাজের আগমন বেশি হওয়ায় খোলা পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে ৪-৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বে-টার্মিনালসহ বেশ ক’টি বড় প্রকল্প হচ্ছে। ভবিষ্যতে ওয়েটিং টাইম আরও কমে আসবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ৩০ লাখ কনটেইনার পরিবহনের রেকর্ড ছুঁয়েছে। এর ফলে বন্দর প্রবেশ করেছে ‘থ্রি মিলিয়ন ক্লাবে’। বছরে ৩০ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারে এমন বন্দর বিশ্বে রয়েছে ৬০টির মতো।
গত আগস্টে লন্ডনভিত্তিক শিপিংবিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সংবাদমাধ্যম ‘লয়েডস লিস্ট’ প্রকাশিত তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ১০০ ব্যস্ত বন্দরের মধ্যে ৬৪তম হিসেবে স্থান পায়। এক বছরের ব্যবধানে ছয় ধাপ এগিয়ে যায় এ বন্দর। ২০১৮ সালে বিশ্বের বন্দরগুলোর কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা হিসাব করে এই তালিকা করা হয়। তালিকা অনুযায়ী, ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ছিল ৭০তম অবস্থানে।
যুগান্তর