ভোরের আভা ডেস্ক: ঊর্ধ্বমুখী আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলনের ভিত্তিতে নয়, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন যোগ্যতা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে ব্যয়ের ক্ষেত্রে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে বড় ধরনের কাটছাঁটসহ নানা সমস্যার সন্মুখীন হতে হবে। অন্যদিকে সরকারকে বাড়তি অর্থের রাজস্ব জোগান দিতে বাধ্য হয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দিয়ে (এনবিআর) অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে- যা সামগ্রিকভাবে ভোক্তার ব্যয় বাড়বে ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
আসন্ন বাজেট নিয়ে যুগান্তরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদ্দাম হোসেন ইমরান-
প্রশ্ন : এবারের বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট বলা হচ্ছে। এ বাজেটে সরকারের কোন কোন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন আছে?
উত্তর : বাজেটকে নির্বাচনী বাজেট বলা যাবে না। বরং চলমান বাজেটই ছিল নির্বাচনী বাজেট। বস্তুত নতুন বাজেট হবে দুই সরকারের বাজেট। কারণ বর্তমান সরকার বাজেট বাস্তবায়নে ৬ মাস সময় পাবে। নির্বাচনের পর পরবর্তী সরকার বাকি ৬ মাসের বাজেট বাস্তবায়নে কাজ করবে।
বাংলাদেশে উন্নয়ন ব্যয়ের গতি প্রকৃতি পর্যালোচনায় প্রথম ৬ মাসের মধ্যে বাজেটের আওতায় সরকারের তেমন দৃশ্যমান কিছু করার সুযোগ কম। তবে পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসার অভিপ্রায় ও ধারণা থেকে সরকার বাজেট সম্প্রসারণ করতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
এ বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগকে চাঙা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকনির্দেশনা এবং ব্যাংকিং খাতসহ সরকারি আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর গুণগতমান বজায় রেখে যথাসময়ে বাস্তবায়নে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।প্রশ্ন : আয়কর অধ্যাদেশে দীর্ঘদিন যাবত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া আছে। এখন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ চাইছেন- এটি সমর্থন করেন কিনা?
উত্তর : অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) মূলধারার অর্থনীতিতে নিয়ে আসতে বৈধ করার সুযোগ দেয়া উচিত, কিন্তু সেটা অবারিত সময়ের জন্য হতে পারে না। সরকার বহুদিন যাবৎ এ সুযোগ দিয়ে আসছে। কিন্তু কেউ এ সুযোগ নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে বিনা শর্তে, নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে, অপারগতায় জেল-জরিমানা ও দণ্ড-সুদের বিধান প্রয়োগের ঘোষণা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া উচিত হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ না করলে সরকারের কোনো সংস্থা যদি তা শনাক্ত করতে পারে তাহলে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে- আইনে এ ধরনের বিধান না থাকলে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ অনন্তকাল ধরে দিলেও সে সুযোগ কেউ নেবে না। এতে বরং সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন এবং উল্টো অসৎরা দীর্ঘমেয়াদে আয় গোপনে উৎসাহিত হবেন।
প্রশ্ন : কর্পোরেট কর হার কমালে বিনিয়োগ বাড়বে- দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবসায়ীরা এ কথা বলছেন। এর যৌক্তিকতা কতটুকু?
উত্তর : দেশে কর্পোরেট কর হার বেশি, কর হার কমালে বিনিয়োগ বাড়বে- সাধারণ অর্থে এ দুটি যুক্তিই সঠিক। তবে এর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আরও বিশদ পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। কারণ কর্পোরেট কর কমালে মুনাফার উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যবসায়ীরা আসলেই বিনিয়োগ করবেন কিনা এবং যারা সঠিকভাবে কর দেন না তারা কর পরিশোধে উৎসাহিত হবেন কিনা- সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। হ্রাসকৃত কর্পোরেট করের টাকায় বেসরকারি খাত কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে বা অর্থনীতিতে কী পরিমাণ নতুন বিনিয়োগ আসতে পারে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, কর্পোরেট করসহ অন্য করের টাকায় সরকার অবকাঠামো ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। কর আদায় কমলে সরকারের আয় কমবে, তখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অবকাঠামো উন্নয়নে ঘাটতি হলে ব্যবসায়ীরাই বিনিয়োগ করতে চাইবে না। এক্ষেত্রে আয়কর অধ্যাদেশে বিনিয়োগের শর্ত জুড়ে দিয়ে কর্পোরেট কর কমানো উচিত বলে মনে করি।
প্রশ্ন : বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে কি কি পদক্ষেপ থাকা উচিত?
উত্তর : বেশ কয়েক বছর যাবৎ বেসরকারি বিনিয়োগে গতিশীলতায় নেই। কর্মসংস্থানের দিকে তাকালে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। সরকারি খাতে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে সেটি কর্মসংস্থানহীন। মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। ৩ বছরের প্রকল্প ৭-৮ বছরেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন ব্যয় বাড়ছে, তেমনি অর্থনীতিও ওই উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারছে না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে দুর্বল অবকাঠামো, গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুলতা, ঋণপ্রবাহ ও ব্যাংক ঋণের বাড়তি সুদের হারের মতো প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। বর্তমানে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধা। প্রতিনিয়ত সুদ হার ওঠানামা করছে, শুল্ক-কর ও ট্যারিফ সংক্রান্ত বিধিবিধান জারি ও প্রয়োগে ধারাবাহিকতা এবং স্থায়িত্বতা আনতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম ও কোয়ালিটি একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যারও সমাধানে মনোযোগী হতে হবে।
প্রশ্ন : ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন কিনা?
উত্তর : অবশ্যই, গত ৩ বছর যাবৎ ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা পরিবর্তন করা হয়নি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো উচিত। এনবিআর মনে করছে, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ালে বিশাল জনগোষ্ঠী করের আওতার বাইরে চলে যাবে- এটা ঠিক। তবে যারা করের আওতার বাইরে যাবে তারা সামান্য আয়ের মানুষ। এখান থেকে খুব বেশি আয়করও আদায় হয় না। কর জাল ও মনিটরিং বাড়িয়ে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কর আদায় সম্ভব। অনেক বড় কোম্পানি ও বিত্তবানরা আইনের ফাঁক গলিয়ে এবং নিয়মিত তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাবে বিপুল অংকের কর ফাঁকি দিচ্ছে বা করের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ ধরনের ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে এনবিআর অধিক কর আদায় করতে পারে।
প্রশ্ন : অর্থ পাচারের অভিযোগ বহু পুরনো। নির্বাচনের আগে টাকা পাচার বেড়ে যায় বলে বিদেশি গবেষণা সংস্থার পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। এটি বন্ধে কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
উত্তর : আয়-ব্যয়ে যথাযথ জবাবদিহিতা না থাকায় অর্থ পাচারের মতো ঘটনা বাড়ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লেও শিল্পের উৎপাদন বাড়েনি ও কর্মসংস্থান হয়নি। আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে, রফতানির সব টাকাও দেশে আনা হচ্ছে না। অর্থাৎ সিস্টেমের মধ্যেই টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে অর্থ অর্জনের সুযোগ থাকায় পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। এটি রোধ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। পাশাপাশি সম্পূরক বাজেট পাসের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সাংসদদের আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। অর্থ ব্যয় ও আয় কম-বেশি হওয়ার বিষয় ব্যাখ্যা চাইতে হবে।
প্রশ্ন : আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। এ বিশাল লক্ষ্যমাত্রা জনগণ- ব্যবসায়ীদের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে কিনা?
উত্তর : এখন প্রতিবছর ব্যয়ের বাজেট বড় হচ্ছে। সেই বাজেটে ৫ শতাংশ ঘাটতি রেখে বাকি টাকা সংস্থানের জন্য এনবিআরসহ অন্যদের ওপর চাপ বাড়ছে। এক্ষেত্রে গত বছরগুলোতে কত রাজস্ব আদায় হয়েছিল, এনবিআরের এত বিশাল লক্ষ্যমাত্রা আদায়ের সক্ষমতা আছে কিনা- এগুলো বিবেচনায় নিয়েই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হওয়া উচিত। এক কথায় বলতে গেলে, এনবিআরকে যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় সেটা স্বভাবিকভাবে আরোপিত, অনুমিত নয়। এ আরোপিত লক্ষ্যমাত্রা আদায়ে মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলো রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে যে চাপের মধ্যে পড়ে প্রকারান্তরে তা করদাতার ওপর গিয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : করদাতা হয়রানি কমাতে ও এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে বাজেটে কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
উত্তর : এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে বাজেটে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে এনবিআরের জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির ব্যবহার ও অটোমেশনের বিষয়ে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে রাজস্ব আদায় বাড়বে। পাশাপাশি সব করদাতার কাছে যাওয়া যাবে। হয়রানিও কমবে। যদি কর্মকর্তারা রাজস্ব আদায়ের নতুন নতুন খাত উদ্ভাবনে ব্যর্থ হয় তাহলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর করের বোঝা বাড়তেই থাকবে।
যুগান্তর “