জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বহু প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে প্রাথমিক মতৈক্যে পৌঁছেছে দুই দেশ। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক (গত মাসে) ভারত সফরে এই অগ্রগতি হয়েছে। তিন বছরের জন্য পরীক্ষামূলক এই অন্তর্বর্তী চুক্তি সই হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর মে মাসের সফরে ভারতের পক্ষ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে অন্তর্বর্তী ওই চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্মতি না জানানো হলেও তখন বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নেওয়া হয়। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখেছেন। সেখানে সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্বর্তী চুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক মত এসেছে। ফলে যেকোনো সময় তিস্তা নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তি সই হতে যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান গতকাল রবিবার বলেন, এ ব্যাপারে (তিস্তা চুক্তি) রাজনৈতিক সমাধান হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য খুবই প্রয়োজন। এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক মতৈক্য, সেটা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরও প্রয়োজন এই নদীর পানি, তাই তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ আরো কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সেটাই টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়। এখন এ বিষয় নিয়ে কাজ চলছে।
অন্তর্বর্তী চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার অতীতে আমাদের যেভাবে বলেছে তার প্রতি বিশ্বাস রেখেই বলতে চাই, বহু প্রতীক্ষিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হবে।’
সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রটি জানায়, গত ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তী চুক্তির একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত নিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়। বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে শেখ হাসিনার কাছে বিষয়টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোলাসাও করেন।
এ বছর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাই সরকার চাচ্ছে, ডিসেম্বরের আগেই তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সই হোক। তিস্তা চুক্তি বর্তমান সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। যদি এই চুক্তি সই হয়, তাহলে তা হবে সরকারের কূটনীতির একটি বড় সাফল্য। এর মাধ্যমে শুধু তিস্তা নদীর পানিই বাংলাদেশে আসবে না, ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকারের বোঝাপড়া ও ভালো সম্পর্কের বিষয়টিও দৃশ্যমান হবে, যা মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের সঙ্গেও ছিল।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু থেকেই এ চুক্তিতে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। তাঁর যুক্তি, এ চুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ওপর। ফলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করতে পারেনি। এ নিয়ে তারা দফায় দফায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সর্বশেষ শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফলপ্রসূ আলোচনার পর শর্তসাপেক্ষে তিনি অন্তর্বর্তী এ চুক্তিতে সম্মত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
এর আগে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল লন্ডনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধান পর্যায়ের সম্মেলনের ফাঁকে শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়। গত বছর এপ্রিলে শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই বৈঠকে তিস্তা চুক্তির অঙ্গীকারের বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
এরও আগে ২০১৫ সালের ৬ জুন প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তা চুক্তির বিষয়ে এ দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন। ওই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘ভারতের রাজ্যগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তিস্তা ও ফেনী নদীর সমস্যার সমাধান করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’ মোদি এ বক্তব্য দেওয়ার আগে ওই দিনই সোনারগাঁও হোটেলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বাংলা নিউজ