কাজের খোঁজে বেঙ্গালুরুতে এসেছিলেন কালুয়া রাম। কিন্তু এই ব্যস্ত শহরে তিনি মানুষজনকে সন্দেহ, গুজব আর আতঙ্কের মধ্যে দেখতে পেলেন। কয়েকদিন আগেই হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে শিশু অপহরণকারীদের যে ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, তার জের ধরেই কালুয়া রামকেও একজন অপহরণকারী বলে মনে করেছিল মানুষজন।
একটি মোবাইল ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে তার জীবনের শেষ কয়েকটি মুহূর্ত। একদল মানুষ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে।
ওই ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, রাভি চানানাভা বলছেন, উত্তেজিত জনতা তাকে পিটিয়ে মেরেছে, তাদের মধ্যে নারী আর শিশুরাও ছিল, যারা এমনকি ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে তাকে পিটিয়েছে।
তিনি বলছেন, ”তারা তার হাত-পা বেধে রাস্তার মধ্যে টেনেছে, পিটিয়েছে, এসব কারণেই সে মারা গেছে।”
যে স্থানে কালুয়াকে হত্যা করা হয়, সেটি শহরের একটি ব্যস্ত এলাকা, যেখানে অসংখ্য বাড়িঘর আর দোকান রয়েছে। কোন প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরগুলোর একটি, প্রযুক্তি কেন্দ্র বেঙ্গালুরুর একেবারের কেন্দ্রে এই জায়গা, যেখানে মিথ্যা খবর আর গুজবের কারণে একজন তরুণকে প্রাণ হারাতে হল।
ভারতে পুলিশ বলছে, গত দেড়মাসে অন্তত ১৪জনকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনাটি হয়েছে ত্রিপুরায়, যেখানে দু’দিনে ৪জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে এমন একজনও রয়েছেন, যিনি ছেলেধরার গুজবরোধে সরকারী প্রচার চালাচ্ছিলেন। পুলিশ বলছে, মোবাইল ফোনের অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপে গুজব ছড়িয়ে পড়ার জেরে এসব ঘটনা ঘটেছে।
সামাজিক মাধ্যমের পাশাপাশি বানোয়াট খবরের শিকার হয়েছে প্রচলিত গণমাধ্যমও
মিথ্যা বা বানোয়াট খবর সবসময়েই বিপদের আর সামাজিক মাধ্যম আর স্মার্ট মোবাইল ফোনের কারণে এখন সহজেই সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তাতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। সারাবিশ্বেই এটি এখন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারতে এখন সেটি হয়ে পড়েছে জীবন-মৃত্যুর একটি সমস্যা।
সম্প্রতি ভারতে ছড়িয়ে পড়া হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে বলা হচ্ছে, দুইশ’র বেশি শিশু অপহরণকারী বেঙ্গালুরুতে এসেছে। নিউজ চ্যানেলে এই খবরটি প্রকাশ করে বলা হয়, শিশুদের অপহরণ করতে পাঁচ হাজার এরকম অপহরণকারী শহরে ঘোরাফেরা করছে। অভিভাবকদের সতর্ক করতে বিশাল হেডলাইনও করা হয়।
ভারত জুড়ে একটি সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখা যায়, দুইজন ব্যক্তি একটি মোটরসাইকেলে করে একটি শিশুকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
শিশু অপহরণ থেকে সতর্ক করতে পাকিস্তানে এই ভিডিওটি তৈরি হলেও, ভারতে এটি বিকৃত আকারে ছড়িয়ে পড়েছে
যেখানে কালুয়াকে হত্যা করা হয়েছে, সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দাকে ওই ভিডিওটি দেখান বিবিসির সংবাদদাতা। তারা এটিকে সত্যি বলে মনে করেন।
কিন্তু এটি আসলে ভারতের কোন ভিডিও নয়। এটি আসলে পাকিস্তানে দুইবছর আগে তৈরি করা একটি ভিডিও, যেটি শিশু অপহরণ থেকে সতর্ক করতে প্রচারণার চালাতে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেই ভিডিওটি এডিট করে এখন প্রচার করা হচ্ছে আর সস্তা স্মার্টফোনের কারণে সেটি সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে।
বেঙ্গালুরুর একজন নারী বলছেন, ”এই ভিডিও দেখার পর আর খবর শোনার পর, আমরা আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছি। এখন আর আমরা তাদের বাইরে পাঠাতে চাই না।”
এসব গুজব আর ভুয়া খবর থেকে সতর্ক করতে মাইকে প্রচারণা করছে স্থানীয় পুলিশ।
বানোয়াট ভিডিও হলেও বাঙ্গালোরের অনেক বাসিন্দা সেটিকে বিশ্বাস করেন
ভুয়া নিউজের বিরুদ্ধে লড়াই করছে পুলিশ সদর দপ্তরও, যেখানে প্রচলিত মিডিয়াগুলোর পাশাপাশি ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের ওপর নজর রাখছে পুলিশ। সেখানে কি ধরণের খবর ছড়াচ্ছে, কি ভিডিও বেশি শেয়ার হচ্ছে এবং সেগুলোর সত্যতা যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
তবে বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার সুনীল কুমার বলছেন, এখানে মিডিয়ার অনেক কিছু করার আছে।
তিনি বলছেন, ”আমি মিডিয়াকে এই অনুরোধ করছি, যেকোনো বিষয়ে আগে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিন। নির্ভরযোগ্য নয়, এরকম কোন খবর প্রকাশ না করে, আগে সেটির বিষয়ে খোঁজখবর নিন।”
সাম্প্রতিক ভুয়া খবরের জোয়ারে ভারত জুড়ে আটজন মানুষ নিহত হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া বা মিথ্যা খবরের বিষয়টি হয়তো সবার জন্যই চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু ভারতে সেটি জীবন-মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবিসি বাংলা