আভা ডেস্ক: তারা আসলে সবকিছুই করছেন। কিন্তু বলছেন, কিছুই করছেন না। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কথা। আগামী ২৫ জুলাই দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশন কাল শনিবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে। এই নির্বাচনের ফল ‘নিজেদের মতো’ করে নিতে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এমন ভূমিকা নতুন কিছু নয়। দ্য ইকনোমিস্ট বলছে, ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে (পিপিপি) পরাজিত করতে বিরোধী দলগুলোকে অর্থ দিয়েছিল সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বা ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স। এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রভাব খাটানোর নানা আলামত আগেই পাওয়া গেছে। নানাভাবে সেগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। আর এ কারণেই চলতি মাসের শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্যের জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আসিফ গফুর আসন্ন নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব খাটানোর প্রস্তুতির অভিযোগ নাকচ করে দেন। কিন্তু নির্বাচনকে ঘিরে আলামতগুলো কিন্তু উল্টো কথা বলছে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ
চলতি বছরের মার্চে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তার করার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। বেলুচিস্তান প্রদেশে নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) ক্ষমতায় থাকলেও তাঁর দলের কয়েকজন আইনপ্রণেতা সিনেট নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান। নওয়াজের মিত্ররা অভিযোগ তোলেন, এখানে আসলে আইএসআই কলকাঠি নেড়েছে। সেটা সত্যি প্রমাণিত হয়, যখন নওয়াজের দলের সাবেক আইনপ্রণেতারা স্বতন্ত্র আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে মিলে সেনাবাহিনীপন্থী বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) গঠন করে। পরে সিনেটের চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনে নওয়াজের দলের প্রার্থী হেরে যান। বেলুচিস্তানের বাসিন্দা হিসেবে প্রথমবারের মতো সিনেটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সাদিক সাঞ্জরানি।
নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করতে চাইলে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। সেনাবাহিনী সেই কাজটি ভালোভাবেই করে যাচ্ছে। রহস্যময় কারণে দেশটির জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল জিও সম্প্রচার কিছুদিন আগে বন্ধ করে দেয় কেবল নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠানগুলো। নওয়াজকে আজীবন রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আদালতের দেওয়া রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছিল জিও। এ ছাড়া সেনাবাহিনী যুক্ত থাকা একটি প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিল বেসরকারি এই টিভি চ্যানেলটি। তার কিছুদিন পরই জিও টিভিকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি কয়েক ঘণ্টার জন্য অপহরণ করা হয়েছিল সাংবাদিক গুল বুখারিকে। এই সাংবাদিক নওয়াজের সমর্থক বলে পরিচিত। এ ছাড়া গত সপ্তাহেই উদারপন্থী পত্রিকা বলে পরিচিত দ্য ডন দেশটির অনেক জায়গায় বিতরণে বাধা দেওয়া হচ্ছে।
কেমন ফল চায় সেনাবাহিনী
অনেক পাকিস্তানির মতো পিটিআইয়ের নেতা ইমরান খানও অস্বীকার করেন না যে, সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। আদালতের রায়ে নওয়াজের প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য হওয়া, আজীবন রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়া এমনকি নিজের দলের প্রধানের পদেও থাকতে না পারার পেছনে ইমরানের হাত রয়েছে। ইমরানই তো তাঁকে আদালতের মুখোমুখি করেছিলেন। নওয়াজের এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভবানও হয়েছেন ইমরান। নানাভাবে এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে, জনপ্রিয়তা-গ্রহণযোগ্যতা মিলে এই মুহূর্তে ইমরান সেনাবাহিনীর পছন্দের রাজনীতিক। কিন্তু ইমরান নির্বাচনে জিতে এককভাবে সরকার গঠন করবেন—এটাও হয়তো সেনাবাহিনী চায় না। তাদের চাওয়া হলো ঝুলন্ত পার্লামেন্ট। নওয়াজের ঘাঁটি (বিদায়ী পার্লামেন্টে নওয়াজ পাঞ্জাবের ১৪৮টির মধ্যে ১১৩ আসন পান) বলে পরিচিত পাঞ্জাব প্রদেশে তাঁর দলের অনেক নেতাকেই নানা গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। নওয়াজের দল না ছাড়লে দুর্নীতির অভিযোগে মামলায় দেওয়াসহ হয়রানির ভয় দেখানো হচ্ছে। এ বিষয়টি অনেক রাজনীতিক স্বীকারও করেছেন। এভাবে নওয়াজের কিছু নেতাকে হটাতে পারলে লাভ হবে মূলত ইমরানেরই। পাঞ্জাবে ইমরান ভালো করতে পারলে জোট সরকারের প্রধান হওয়ার সম্ভাবনায় তিনিই এগিয়ে থাকবেন। এ বিষয়ে সাবেক কূটনীতিক হুসেইন হাক্কানি বলছেন, ইমরানকে নেতা করে ঝুলন্ত পার্লামেন্টই হয়তো পছন্দ করবে সেনাবাহিনী।
চাওয়া পূরণ হবে সেনাবাহিনীর?
সেনাবাহিনীর চাওয়া পূরণ হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। সবকিছু নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও ভোটারের মন তো আর সেনা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। নওয়াজের প্রতি সেনাবাহিনী ও বিচারবিভাগের আচরণে তাঁর প্রতি জনগণের সহানুভূতি বাড়ছেই। তার প্রমাণ মেলে মে মাসে গ্যালাপের জরিপেও। গ্যালাপের ওয়েবসাইট বলছে, সবার চেয়ে এগিয়ে আছে নওয়াজের পিএমএল-এন (৩৮শতাংশ)। তার পরেই আছে ইমরানের পিটিআই (২৫শতাংশ); তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জারদারি-বিলাওয়ালের পিপিপি (১৫ শতাংশ)। জাতীয়ভাবে নওয়াজ ইমরানের চেয়ে ১৩ শতাংশ এগিয়ে থাকলেও নিজের ঘাঁটি পাঞ্জাবে এগিয়ে আছেন ২০ শতাংশ। নওয়াজের দলের ইভেন্টগুলোতে জনসমাগমও হয় অন্য দলগুলোর চেয়ে বেশি। রাওয়ালপিন্ডির বাসিন্দা মোজাফফর মুগল বলেন, ‘আমরা জানি নির্বাচনের ফলাফলে হস্তক্ষেপের আশঙ্কা আছে। কিন্তু আমরা নওয়াজকেই ভোট দেব।’
এদিকে অতীতে যা হয়নি, এবার তাই হচ্ছে পাকিস্তানে। সরাসরি সেনাবাহিনীর সমালোচনা করছে নাগরিক অধিকার সংগঠন পশতুন প্রটেকশন মুভমেন্ট (পিটিএম); যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ২৪ বছরের তরুণ মনজুর পাশতিন। বিবিসি বলছে, সংগঠনটি জঙ্গি বিরোধী সেনা অভিযানে নির্বিচারে গ্রামের পর ধ্বংস করে ফেলার ব্যাপক প্রতিবাদ জানিয়েছে। গুম হওয়া প্রায় ২০ হাজার মানুষের সন্ধানের দাবিতে জাতিসংঘের তদন্তও দাবি করা হয়েছে। শুরুতে পিটিএমের প্রতি কঠোর হলেও ইদানীং যেন কিছুটা নমনীয় হয়েছে সেনাবাহিনী। সম্প্রতি আটক হওয়া পিটিএমের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের জামিন পাওয়াটা তারই ইঙ্গিত বহন করে।
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন। এএফপির ফাইল ছবিতবে আসন্ন ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনে কোনো কারণে সেনাবাহিনী নিজেদের মনমতো ফল না পেলে কী করবে—সেটা ধারণা করা কঠিন। ৭১ বছর বয়সী পাকিস্তানের বেশির ভাগ সময় কেটেছে সামরিক শাসন বা সামরিক উর্দির আড়ালে থাকা সেনাশাসনে। সরাসরি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছেন কোনো কোনো জেনারেল। সেখানে জেনারেল কামার জাবেদ বাজওয়া যে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা না নিয়ে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে পছন্দমতো ফল আনার চেষ্টা আছেন—এটাই যেন দেশটির রাজনীতিবিদ তথা জনগণের সৌভাগ্য!
প্রথম আলো