আভা ডেস্ক: ২৫ জুন সোমবার প্রথম আলোর মতামত পাতায় বিদগ্ধ টিভি দর্শক নিশাত সুলতানা একটি মতামত লিখেছেন, ‘কে বাঁচাবে টেলিভিশনের নাটক?’ তাঁর এ হতাশাব্যঞ্জক প্রশ্নের উত্তরে অনেক কথা বলা যায়। শুধু সংক্ষেপে বলব, আমাদের টিভি নাটকের ঐতিহ্য ও শিল্পমান গড়ে উঠেছিল যে চ্যানেলটির হাতে, সেই বিটিভিই হয়তো হতে পারত টিভি নাটকের ত্রাতা। কিন্তু দুঃখজনক, বিটিভি আজ খাবি খাচ্ছে আমলাতান্ত্রিকতার জালে।
আমরা আজ বিটিভিরই একটি অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু করব আমাদের টিভি সমালোচনা। ২৩ জুন সকাল ৮টায় বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত হলো সংগীতবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’। অনুষ্ঠানে এদিন শিল্পী ছিলেন মোখলেসুর ইসলাম। তিনি একটানা প্রায় ঘণ্টাব্যাপী গান করেছেন এ অনুষ্ঠানে। অধিকাংশই অতীতের বিভিন্ন শিল্পীর জনপ্রিয় গান। যেমন ‘বড় একা একা লাগে তুমি পাশে নেই বলে’, ‘কত দিন দেখিনি তোমায়, তবু মনে পড়ে তব মুখখানি’, ‘তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে কান্দাইয়া’ ইত্যাদি। তাঁর কণ্ঠ মিষ্টি কিন্তু কিছুটা চাপা, যে কারণে তিনি যখন উঁচু পর্দায় গাইছিলেন, তখন সুরটি সাবলীল মনে হচ্ছিল না। তাঁর উপযুক্ত চর্চার অভাব মনে হয়েছে। যেমন তিনি যে কটি গান পরিবেশন করেছেন, সব সুরেই করেছেন, কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মনে হয়েছে কণ্ঠ যেন সুরের পর্দায় ঠিক লাগছে না। আর তাঁর উপস্থাপনা এবং কথোপকথনে কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। শেষে একজন দর্শকের অনুরোধে ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি’ গানটির অংশবিশেষ গাইতে গিয়ে তিনি বাণী ভুলে হু হু করে মিলিয়ে দিয়েছেন। যদিও তিনি ক্ষমা চেয়েছেন, তবু গণমাধ্যমের জন্য বিষয়টি বেশ বেমানান।
২২ জুন বেলা ৩টায় চ্যানেল আইয়ে নব্বই দশকের একটি ঘটনা অবলম্বনে প্রচারিত হলো টেলিছবি ঘাস। রচনা মাসুমা মায়মুর; পরিচালনায় গোলাম হাবিব; অভিনয়ে নাজনীন চুমকি, সুষমা সরকার, রাজীব সালেহীন প্রমুখ। সংক্ষেপে টেলিছবির গল্পটি এ রকম—নাজনীন চুমকি অনেক স্বপ্ন নিয়ে সাধনা করে ছেলের মা হলো এবং ছেলের নাম রাখল জাফর। স্বামী-স্ত্রী অনেক কষ্ট করে জাফরকে বড় করল। শিক্ষিত মেয়ে দেখে বিয়ে করাল। কিন্তু শিক্ষার অজুহাতে বউটা হলো দেমাগী ও দায়িত্বহীন। এরপর স্বামীকে হারিয়ে নাজনীন হলো ছেলের আশ্রিতা এবং ছেলে-বউয়ের গৃহকর্মী। একপর্যায়ে সে প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী হলে ছেলে-বউ তার সেবা-শুশ্রূষার ভয়ে খাবার বন্ধ করে দিল। ক্ষুধার যন্ত্রণায় সে গড়িয়ে গড়িয়ে পুকুরপাড়ে ঘাস খেতে গিয়ে পানিতে পড়ে মারা গেল। গ্রামবাসী মৃত নাজনীনের মুখ থেকে বের করল থোকা থোকা ঘাস। এই হলো টেলিছবি ঘাস। নামকরণ যথার্থ। ছবির এই ছোট্ট পরিসরে তিন পুরুষের জীবনধারা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নাট্যকার ও নির্মাতা। এদিক বিবেচনায় বলা যায়, ঘাস টেলিছবিটি কাহিনিনির্ভর। জীবনের যে নিষ্ঠুরতা ও রূঢ় বাস্তবতা নির্মাতা ছবিটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই দর্শককে শিহরিত করেছে। মাঝে মাঝে কিছুটা অতিরঞ্জিত মনে হলেও অবাস্তব মনে হয়নি। নাজনীন চুমকি ও রেহনুমার অনবদ্য অভিনয় টেলিছবিকে করেছে প্রাণবন্ত। শৈল্পিক দিকটিতে কিছুটা ঘাটতি থাকলেও আমাদের গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য টেলিছবিটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।
এবারে নাটক। ২২ জুন রাত ৮টা ৩০ মিনিটে আরটিভিতে প্রচারিত হলো বিশেষ নাটক ছোট ছেলে। রচনায় মাসুম শাহরিয়ার, পরিচালনায় আবু হায়াত মাহমুদ, অভিনয়ে তৌসিফ, রেহনুমা, এস এম মহসিন, শতাব্দী ওয়াদুদ প্রমুখ। নাটকের গল্প হলো, বাড়ির ছোট ছেলে তৌসিফ ভালোবাসে একটি মেয়েকে। কিন্তু বেকারত্বের কারণে সে বিয়ে করতে পারে না। মেয়েটি বিরক্ত। এদিকে উপার্জন না করায়, সংসারের কোনো দায়দায়িত্ব পালন না করায় পরিবারের সবাই তার ওপর বিরক্ত। এমনি সংকটের মাঝে সে একদিন বাধ্য হয়ে প্রেমিকাকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসে। তারপর বাবা-মা বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে বড় ভাই ও ভাবির সহায়তায় সে কিছুটা আশ্রয় পায়। এরপর বড় ভাইয়ের মুখ থেকেই জানা যায়, বাবার চিকিৎসায় ও সংসারের বিভিন্ন প্রয়োজনে বেকার তৌসিফের রয়েছে অনেক অবদান। তখন সবাই ছোট ছেলে ও বউকে কাছে টেনে নেয়।
এককথায় বলা যায়, নাটকের গল্পটি আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের অতিপরিচিত ও চিরায়ত। এখানে আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকার একটা প্রয়াসও আছে। এদিক থেকে গল্পটি দর্শকের কাছে আপনই মনে হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়, নাটকটি দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়ে গেছে মিজানুর আরিয়ানের বড় ছেলে নাটকটির কথা। হুবহু একই আবেগ এবং উপলব্ধি অবলম্বন করা হয়েছে এ নাটকেও। নামকরণও করা হয়েছে বড় ছেলে অনুসরণ করে ছোট ছেলে। নামকরণটি ভিন্ন হলেও বোধ হয় দর্শকের এ সমস্যা হতো না। তা ছাড়া বড় ছেলে নাটকটি যেভাবে দর্শকহৃদয় স্পর্শ করেছে, ছোট ছেলে তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। তার একটি কারণ মনে হয়েছে, একই ইমেজের ব্যবহার। আর দ্বিতীয়টি, বড় ছেলে নাটকে বড় ছেলের চরিত্রায়ণে নির্মাতা যতটা সফল ছিলেন, ছোট ছেলের চরিত্রায়ণ মোটেই সে সফলতা স্পর্শ করতে পারেনি। চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং অভিনয়েও রয়েছে ব্যাপক ফারাক। শেষ কথা, শিল্পক্ষেত্রে দর্শক অনুকরণ বা অনুসরণ কোনোটাই পছন্দ করেন না, গ্রহণও করেন না।
প্রথম আলো