আভা ডেস্কঃ কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে যেমন দেশে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা পাচার হয়ে আসে, তেমনি রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত পথে দেশে সবচেয়ে বেশি হেরোইন পাচার হয়ে আসে। রাজশাহী জেলা পুলিশের এক প্রতিবেদনে স্থানীয় ছয়জন আইনজীবীকে ‘মাদক ব্যবসায়ীদের আইনজীবী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
‘মাদক ব্যবসায়ীদের আইনজীবী’ হিসেবে চিহ্নিত আইনজীবীদের মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলার সালাহউদ্দিন বিশ্বাসেরও নাম রয়েছে। আইনজীবী সালাহ উদ্দিন বিশ্বাসকে বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী থেকে রাজধানীর শাহবাগ থানা পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মাদকের মামলায় হাইকোর্টের জামিন জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলায় রাজধানীর শাহবাগ থানা পুলিশ বৃহস্পতিবার ভোরে গোদাগাড়ী পৌরসভার মহিষালবাড়ি মহল্লার নিজ বাড়ি থেকে সালাহউদ্দিন বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অমল কৃষ্ণ দে তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মামলাটির বাদী সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তরের সুপারিনটেডেন্ট মজিবর রহমান। গত মার্চে মামলাটি দায়ের করা হয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর গোদাগাড়ী উপজেলার আঁচুয়াভাটা গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম ওরফে বাবু ৫৫০ গ্রাম হেরোইনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এরপর রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তার কয়েকদফা জামিনের আবেদন নাকচ হয়। এ অবস্থায় হাইকোর্টে তার জামিন চাওয়া হয়। জামিন পেতে আশরাফুলের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া হেরোইনের পরিমাণ ৫৫০ গ্রামের পরিবর্তে ৪৮ গ্রাম উল্লেখ করা হয়।
রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি এন্তাজুল হক বাবু জানান, ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আসামি আশরাফুলের অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে আইনজীবী সালাহউদ্দিন বিশ্বাস রাজশাহীর বিচারিক আদালতে আশরাফুলের মুক্তির জন্য বেলবন্ড দাখিল করেন। তখনই জামিন জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর আসামির জামিন বাতিল হয়। পরে আশরাফুল আর জামিন পাননি। সম্প্রতি তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল জামিন জালিয়াতির বিষয়টি জানিয়ে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্টের জামিন আদেশটি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে পাঠায়। পরে ২৭ মার্চ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় জামিন আদেশ ও মামলার নথিপত্র আদালতে দাখিল করে। সেদিন সংশ্লিষ্ট আদালতের আইন কর্মকর্তা আসামির জামিন বাতিল ও জামিন জালিয়াতির ঘটনায় অন্য কারা জড়িত তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) মাধ্যমে তদন্ত করার আবেদন করেন।
এ সময় হাইকোর্ট আসামির আইনজীবী রিফাত জাহানের কাছে জানতে চান, মামলাটি তিনি কীভাবে পেয়েছেন? পরে তাকে হলফনামা আকারে ঘটনাটি আদালতে দাখিল করতে বলা হয়। রিফাত জাহান আদালতে দাখিল করা তার হলফনামায় বলেন, ‘তিনি তার সিনিয়র আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমানের কথা মতো আসামি আশরাফুলের জামিন আবেদনে আবেদনকারী আইনজীবী হয়েছিলেন। আইনজীবী শেখ আতিয়ার রহমান মামলাটি ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী শিউলী আক্তারের মাধ্যমে পেয়েছেন।’
এদিকে হাইকোর্টের জামিন জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করতে বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. খসরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ সিআইডিকে নির্দেশ দেন। সিআইডি দীর্ঘ সময় ধরে বিষয়টির তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টারের দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। ওই প্রতিবেদনসহ গত ৯ মার্চ শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়।
এ মামলার অন্য আসামিদের নাম না জানালেও পুলিশ জানিয়েছে, রাজশাহীর আইনজীবী সালাহউদ্দিন বিশ্বাসসহ আরও আসামি আছেন। সালাহউদ্দিন বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি পাঁচ কেজি হেরোইন জব্দের পর নমুনা পরীক্ষায় সেটি হেরোইনের পরিবর্তে ‘বাদামি গুড়া’ প্রতিবেদন এলে আইনজীবী সালাহউদ্দিন বিশ্বাসের সংশ্লিষ্টতা পুলিশ জানতে পারে। ওই চক্রে কিছু অসাধু পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। পাঁচ কেজি হেরোইনের নমুনা পরীক্ষার পর ঢাকা থেকে ‘বাদামি গুড়া’ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পুলিশ আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দাখিল করে। পরে নমুনা পাল্টানোর ঘটনাটি জানাজানি হলে মামলাটির পুনঃতদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর র্যাব ৫ কেজি হেরোইন জব্দ করে। এ ঘটনায় গোদাগাড়ীর মো. সাজেমান (৩৭) ও মো. আলমের (৪৫) বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা গোদাগাড়ী থানার এসআই আবদুর রাজ্জাক (নিরস্ত্র) জব্দকৃত আলামত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে পাঠান। তার বদলিজণিত কারণে গোদাগাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলতাব হোসেন তদন্তভার পান এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন।
এদিকে অজ্ঞাত ফোন পাওয়ার পর রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. শহিদুল্লাহ জেলা বিশেষ শাখার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটি গতবছর ২৯ মে পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, হেরোইনের আলামতের প্রতিবেদন পাল্টে ফেলা হয়েছে। এরপর নতুন করে মামলাটির তদন্ত শুরু হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে রাজশাহীর ছয়জন আইনজীবীকে মাদক ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত আইনজীবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেফতার হওয়া সালাহউদ্দিন বিশ্বাসও রয়েছেন বলে পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ব্যাপারে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই অমল কৃষ্ণ দে বলেন, আইনজীবী সালাহউদ্দীন বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। মামলার তদন্তের স্বার্থে আইনজীবী সালাহউদ্দিন বিশ্বাসকে রিমান্ডেও নেয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।
ইত্তেফাক