রাজশাহীর টেনিস কমপ্লেক্স থেকে রাজাকার ‘জাফর ইমাম’ এর নাম সরানো হলো ।

আভা ডেস্কঃ মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর অবশেষে রাজশাহীর আন্তর্জাতিক টেনিস কমপ্লেক্স থেকে রাজাকার ‘জাফর ইমাম’ এর নাম সরানো হয়েছে। শিগগিরই নতুন নামে দেখা যাবে আন্তর্জাতিক এই টেনিস কমপ্লেক্সকে। এ ঘটনাকে বিজয় হিসেবেই দেখছেন রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, জাফর ইমাম বরাবরই খোলস বদল করে চলেছেন। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ক্রীড়া কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার চাকরি চলে যায়। পরে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন। পরে ১৯৭৩ সালের দিকে আবারও তিনি চাকরি ফিরে পান। ওই সময় কতিপয় ছাত্রলীগ নেতা তাকে সমর্থন করে শিক্ষাবোর্ডে গার্ড দিয়ে অফিস করতে নিয়ে আসতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর তিন বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারই তাকে আবার শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠকের পুরস্কার প্রদান করেন।

মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে তার হামলার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর শীর্ষ ছাত্রনেতারা। তার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ৬৯’এর গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতা জাফর ইমামের রাজশাহীর কাজীহাটার বাড়িতে হামলা চালায়। তখন তিনি পালিয়ে রক্ষা পান। পরে আশ্রয় নেন তার স্ত্রী ডা. জোবায়দার কাদিরগঞ্জের বাড়িতে। সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাদের আড্ডা হতো। মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রনেতাদের তালিকা হানাদারদের হাতে তুলে দিতেন এই জাফর। তার তালিকা দেখেই চলতো গণহত্যা। বাবলাবন গণহত্যাও তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার হুমায়ুন কবীর বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাফর ইমামকে স্বাধীনতা বিরোধী কুখ্যাত রাজাকার উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে লিখিত অভিযোগ দিলে তা তদন্ত করার জন্য সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। তদন্তকালে জাফর ইমাম রাজাকার ছিলেন- তা প্রমাণিত হয়। তদন্ত কমিটি বিষয়টি অবহিত করলে টেনিস কমপ্লেক্সের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচালনা কমিটিকে বিষয়টি জানাই। যেহেতু সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত এবং আদালতের রায় রয়েছে যে, কোন স্বাধীনতা বিরোধীর নামে কোন স্থাপনা থাকবে না, সে কারণেই নামটি পরিবর্তন করার জন্য মুছে ফেলতে নির্র্দেশ দেই।

তদন্ত কমিটির প্রধান রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু আসলাম বলেন, জাফর ইমাম একজন কুখ্যাত রাজাকার এবং স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন। তার দেয়া তালিকা ধরেই বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করতো পাকিস্তানী আর্মিরা। রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে আইয়ুব খানকে হাত করে এনএসএফ এর এই নেতা জাফর ইমাম ক্রীড়া অফিসার নামে একটি পদ সৃষ্টি করে চাকরিও নিয়েছিলেন। চাকরি জীবনেও সে মুক্তিযুদ্ধের পর পলাতক থেকেছেন। সে অত্যন্ত ধূর্ত একজন মানুষ ছিলেন। তার অপকর্মের শেষ নেই। বিভিন্ন সময় বিদেশে গিয়েও নানা সুবিধা নিয়েছেন। আমার তদন্ত রিপোর্টে এসবই উল্লেখ আছে।

রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, টেনিস কমপ্লেক্সের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিভাগীয় কমিশনার ও পরিচালনা কমিটি ইতিমধ্যেই একমত হয়ে রাজাকার জাফর ইমামের নামটি সরিয়ে ফেলেছে। এখন নতুন নাম দেয়া হবে। আগামী মাসের প্রথমদিনই সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভায় নতুন নাম দেয়া হবে।

তিনি বলেন, ১৯৮১ এই টেনিস কমপ্লেক্সটি প্রথম নাম ছিলো বোয়ালিয়া ক্লাব টেনিস কমপ্লেক্স। পরে ১৯৮২ সালে রাখা হয় রাজশাহী টেনিস কমপ্লেক্স। ২০০৪ সালে জাফর ইমাম মারা যান। ২০০৫ সালে তৎকালিন বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় টেনিস কমপ্লেক্সের নামকরণ করা হয় জাফর ইমাম টেনিস কমপ্লেক্স নামে। মুক্তিযোদ্ধারাও নাম পরিবর্তনের দাবি করতে থাকেন। পরে তদন্ত কমিটি গত এপ্রিল মাসে একটি চিঠি দিয়ে আমাদের জানায়, জাফর ইমাম মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসেবে একাত্তর সালে ভূমিকা রাখেন। তিনি রাজাকার ছিলেন। রাজশাহীর বুদ্ধিজীবিদের বাবলাবনে গণহত্যায় তার জড়িত থাকার প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি।

অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার তাপু বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী কারো নামে রাজশাহীতে কোন প্রতিষ্ঠানের নাম থাকবে না। যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিকে আগের প্রশাসন সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এবার গুরুত্ব দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবিতেই নাম মুছে ফেলা হয়েছে। নতুন নাম খুব সম্ভবত রাজশাহী আন্তর্জাতিক টেনিস কমপ্লেক্স হবে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর টেনিস কমপ্লেক্স পরিচালনা কমিটির সভাতেই নতুন নামটি রাখা হবে।

রাজশাহী মহানগরের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলাউদ্দীন শেখ ভুলু বলেন, আমরা দীর্ঘ সময় আন্দোলন করেছি রাজাকারের নামটি সরানোর জন্য। টেনিস কমপ্লেক্সের নতুন কমিটি নামটি মুছে ফেলেছে। এজন্য তাদের নতুন কমিটিকেও ধন্যবাদ জানাই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমাদের একটাই দাবি, রাজশাহীর কোন বড় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অথবা প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে টেনিস কমপ্লেক্সটির নামকরণ করা হবে।

সাবেক মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার সফিকুর রহমান রাজা বলেন, শুধু রাজাকার নয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দোসর। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির মাস্টার মাইন্ড। রাজশাহীর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল মুসলিম লীগের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা জাফর ইমামের। এই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় হলো।

মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, ‘১৯৬৭ সালে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সেকেন্দার আবু জাফরকে মারধর করার খবর পেয়ে রাজশাহী কলেজে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এনএসএফ সদস্যরা আমাকে আটক করে ‘পাগলা কুকুর’ পেটানোর মতো পেটায়। স্বাধীনতার সময় জাফর ইমাম পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করেছেন। এই নামটি থাকা ছিলো সমগ্র রাজশাহীবাসী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অপমানজনক। সেই অসম্মান থেকে রাজশাহীবাসী এখন রক্ষা পেলেন।

Next Post

রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমীর বিরুদ্ধে মানববন্ধন ।

শনি আগস্ট ২২ , ২০২০
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমীর রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা ও অর্থ কেলেঙ্কারীর বিরুদ্ধে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধ সংসদ রাজশাহী জেলা ও মহানগর শাখার উদ্যোগে শনিবার ( ২২ আগস্ট) নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজশাহী মহানগর ইউনিটের সভাপতি ডা.আব্দুল মান্নান, বক্তব্য রাখেন কবিকুঞ্জের […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links