নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতির বিস্তর চিত্র উঠে এসেছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে । কাজ না করে ঘুষ নিয়ে বিল পরিশোধ । কমিশনে অযোগ্য ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া । সঠিক কাজ করেও নির্ধারিত সময়ে বিল না দিয়ে, উৎকোচনের আশা দিনের পর দিন ঘুরানো । ইজিপি টেন্ডারের নামে ভাওতাবাজি সহ অগনিত অভিযোগ উঠে এসেছে রাজশাহী শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে । করোনাকালেই ঘুষের ৩৮ লাখ টাকা নগরীর একটি ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেছেন তিনি ।
এছাড়াও প্রতিটি টেন্ডারে ২ থেকে ১০ শতাংশ অর্থ না দিলে কার্যাদেশ পাওয়া যায় না। আবার উচ্চ দরদাতা হলেও অর্থের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। গত রমজান মাসে এই দুর্যোগকালেই উক্ত দপ্তরের হিসাব রক্ষক আমিনুল এনসিসি ব্যাংক থেকে প্রকৌশলী রেজাউল ইসলামের ঘুষের ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন । (ভিডিও সংরক্ষিত)
রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলীর যোগসাজশে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আগের নির্বাহী প্রকৌশলী বদলির পর দপ্তরটিতে অনিয়ম ভরে গেছে । যোগদানের পর থেকে মরিয়া হয়ে পড়েন ঘুষ বানিজ্যে । যার ফল স্বরুপ নগরীর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের কাজ না করেই বিল পরিশোধ করেছেন মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে । এ রকম অনেক কাজের বিল তিনি পরিশোধ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেক ভুক্তভুগি ঠিকাদার।
অপর দিকে নিজের অপকর্ম ও অনিময় ঢাকতে সঠিক প্রক্রিয়ায় কাজ করেও বিল পরিশোধ না করেও দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছেন উক্ত দপ্তরের প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার হাসান এন্টারপ্রাইজের মালিক মেহেদি হাসানকে। উলটো তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন ভিন্নতর ভাবে । যা অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত।
ঐ ঠিকাদার আরো বলেন, রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কোন নির্মাণ কিংবা সংস্কার কাজে দরপত্রে অংশগ্রহন করে লটারীর মাধ্যমে কাজ পেলেও শতকরা ২ ভাগ টাকা ঘুষ না দিলে কার্যাদেশ প্রদান করে না। এছাড়াও কাজ শেষ হলে বিল পেতে দিনের পর দিন ধর্ণা দিতে হয় নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে। বিল পেতেও শতকরা ১০ ভাগ টাকা দিতে হয়। এছাড়াও কাজ সংক্রান্ত বিষয় কোন পরামর্শে জন্য ঠিকাদাররা গেলে তাদের সাথে অশোভন আচরন করে রেজাউল ইসলাম । তিনি আরো জানান, সম্প্রতি ১৭ গ্রুপের একটি কাজ আমি সম্পুর্ণ করলেও আমাকে বিল দেওয়া হচ্ছে না। উলটো আমার বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছেন আমি নাকি তাকে হুমকি দিয়েছি । যা সম্পুর্ণ মিথ্যা । তিনি বলেন আমার ভাই রায়হান রাজশাহী কলেজের একটি কাজ করছে, যা বর্তমানে চলমান আছে, কিন্তু সেই কাজের সিডিউল বহি;ভুত আরও বাড়তি কাজ করতে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন উপ সহকারী প্রকৌশলী উজ্জ্বল রায় । যা আমার ভাই করছিলেন না, এতে ক্ষিপ্ত হয় উজ্জল রায়। এরপর থেকে তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে উক্ত প্রকৌশলী । তিনি আরও বলেন উপ সহকারী প্রকৌশলী উজ্জ্বল রায়ের সাথে কোন খারাপ আচারন করেনি আমার ভাই ।
এদিকে অপর এক ঠিকাদার বলেন, ঘুষ ছাড়া ফাইল পাস না করাটাকে তিনি নিয়মের পরিনত করে ফেলেছেন। রাজশাহী শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আরেক ঠিকাদার বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলীকে শতকরা ১০ভাগ টাকা ঘুষ না দিলে কাজের বিল তিনি পাশ করেন না। ছাড়াও তিনি নিয়মিত অফিসে থাকেন না।
ভুক্তভুগি আরেক ঠিকাদার বলেন, সরকারের কাজে গতিশীল ও দুর্নীতি বন্ধে ইজিপি পদ্ধতি চালু করলেও সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। বরং আগে যেসব ঠিকাদার ও কর্মকর্তা টেন্ডারে অনিয়ম করেছেন, তাদের কাছে এটি নতুন কৌশল মাত্র। ইজিপিতে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো প্রকৌশলী প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে নারাজ। কারণ তারা মনে করছেন, সরকারের এই নতুন পদ্ধতির অনিয়ম সম্পর্কে কথা বললে তাদের সমস্যা হতে পারে।
জানা গেছে, ইজিপি চালু করতে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ইজিপি নীতিমালা করা হয়। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬-এর ৬৫ ধারা অনুযায়ী এ নীতিমালা করা হয়। নীতিমালার ভিত্তিতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রিফর্ম প্রজেক্ট-২ এর অধীনে কেন্দ্রীয় ইজিপি পোর্টাল তৈরি করে সিপিটিইউ। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। দরপত্র আহ্বানে ইজিপি পদ্ধতিতে পুঞ্জীভূত দুর্নীতি নতুনভাবে রূপ নিয়েছে। দ্বিগুণ বেড়েছে দরপত্র জালিয়াতি।
শিক্ষা অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাসান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মাদ মেহেদি হাসান ভোরের আভাকে বলেন, সরকার দুর্নীতি ও আধিপত্য বিস্তার দূর করতে ইজিপি পদ্ধতি চালু করে। কিন্তু বাস্তবে এই পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দুর্নীতি আরো বেশি করছে ।
প্রধান কার্যলায় থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত প্রতি স্তরেই ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। টেন্ডারবাণিজ্য বন্ধে সরকার ইজিপি পদ্ধতি চালু করলেও বন্ধ হয়নি এই খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি।
ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করতে না পারলে কাজ পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কাজের প্রাক্কলন মূল্য প্রকৌশলী জানান শুধু তার পছন্দের ঠিকাদারকেই। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে নিজের আত্মীয় স্বজনকে দিয়ে ঠিকাদারি কাজ করানোরও অভিযোগ আছে। ইজিপিতে অযোগ্য অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়ে যাচ্ছে; যা পরবর্তীতে কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে কাজই শেষ করতে পারে না। ফলে বেড়ে যায় প্রকল্প ব্যয়। এসব প্রকল্প একদিকে যেমন সরকারকে সমালোচনার মুখোমুখি করছে, অন্যদিকে বৃদ্ধি করছে জনভোগান্তি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারের সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় কারিগরি এবং আর্থিক যোগ্যতা আছে কি-না দরপত্র নিষ্পন্নকালে যাচাই করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ঠিকাদারের যোগ্যতা আছে কি-না তা যাচাই করছেন না।
ইজিপিতে টেন্ডার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে শিক্ষা অধিদপ্তরের অনেক ঠিকাদার বলেন, অসাধু ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণ করতে কর্মকর্তারাও সরাসরি সহায়তা করছেন। ইজিপির অধীন সব টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া দরকার।
তিনি আরও বলেন, প্রকৌশলীদের টাকা দিতে দিতে শেষ, ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। ইজিপি পদ্ধতি যেটা তা তো তারা মানছে না। ইজিপি দিতে হলে সমস্ত টেন্ডার ডকুমেন্ট আপ টু ডেট, ফাইলপত্র, কাগজপত্র আপ টু ডেট করে, টেন্ডার কল করবে।
কিন্তু এর (প্রকৌশলীরা) কাজের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রাক্কলন (এস্টিমেট) করতে হবে। কিন্তু সেখানে এসব কাগজপত্র সঠিক করার আগেই প্রকৌশলীরা টেন্ডার কল করেন। টেন্ডার কল করার পর কাগজপত্র প্রোসেসিং করেন।
এতে বাধ্যতামূলক ঠিকাদাররা প্রকৌশলীদের কাছে গিয়ে কাজের জন্য কাগজপত্র স্বাক্ষর করান। যেকোনো কাজের ভাগবাটোয়ারা পেতে এই কৌশল অবলম্বন করেন প্রকৌশলীরা। অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে দায়িত্বরত প্রকৌশলীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরাঘুরি করে কাজের এস্টিমেট অনুমোদন করাতে হয়।
অথচ ইজিপির নিয়ম— এস্টিমেট শতভাগ সম্পন্ন হওয়ার পর টেন্ডার কল করলে ঠিকাদাররা অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে টেন্ডার পাওয়ার পর ওয়ার্ক অর্ডার আনতে অফিসে যাবেন ঠিকাদাররা। কিন্তু ইজিপির এই নিয়ম কোথাও মানছে না।
এছাড়া কাজের ২ থেকে ৩ শতাংশ অর্থ ইঞ্জিনিয়াররা নেন। আর বড় কাজগুলোর ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৬ শতাংশ অর্থও নেন তারা। আর ঠিকাদাররা বিল তুলতে গেলে প্রকৌশলীদের টাকা দিতেই হবে। টাকা না পেলে বিলে স্বাক্ষর করেন না। প্রকৌশলীরা ভাবেন, এটি তাদের পৈতৃক সম্পত্তি।
এ বিষয়ে কথা বলতে রাজশাহী শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল ইসলামের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ০১৭১১-২৪০৮০৫ নম্বরে কল দিলে তিনি ফোনটি রিসিভ করেনি ।