উত্তরবঙ্গের আশা ভরসা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

নিজস্ন প্রতিবেদক: প্রায় তিন মাস আগে মাইক্রোর সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বাম পায়ের গোড়ালির নিচে ভেঙে যায় নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলা সদর এলাকার সুশান্তের। পাশাপাশি পায়ের পাতার ওপরের মাংস পর্যন্ত কেটে পড়ে যায়।

অনেকটা মুমূর্ষ অবস্থায় ভর্তি করা হয় সুশান্তকে। প্রথমে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে ভর্তি করে কয়েকদিন পরে তার পায়ের জটিল অপারেশন করা হয়। এরপর পায়ের ওপরের অংশ স্বাভাবিক করতে আরেকটি জটিল অপারেশনের প্রয়োজন হয় সুশান্তের। জটিল এ অপারেশনের জন্য সুশান্তকে অনেকেই ঢাকা বা ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পরামর্শ দেন।
শেষ পর্যন্ত তাঁকে ভর্তি করা হয় রামেক হাসপাতালের বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। এরপর এক মাসের ব্যবধানে দুটি জটিল অপারেশনের মাধ্যমে সুশান্তের পায়ের পাতার ওপরের অংশে মাংস ও চামড়া প্রতিস্থাপন করে দেন ওই ওয়ার্ডের প্রধান চিকিৎসক আফরোজা নাজনীন আশা। এখন অনেকটায় স্বাভাবিক হতে শুরু করেছেন সুশান্ত। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এরই মধ্যে তিনি আস্তে আস্তে হেঁটে চলাফেরাও করতে শুরু করেছেন।
শুধু সুশান্তই নন, তাঁর মতো আরো শত শত রোগী জটিল রোগে বা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে রামেক হাসপাতালে আসছেন চিকিৎসা নিতে। উত্তরাঞ্চলের সর্ববৃহত এই হাসপাতালটিতে এখন অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা পেয়ে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা রোগীরাও চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন হাসিমুখে। পাশাপাশি পরিস্কার-পরিছন্নতা ও কিছু কিছু সেবার দিক দিয়ে রামেক হাসপাতাল গত জুলাই মাস থেকে দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে রয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের জরিপে। মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে এ জরিপ করা হয় বলে জানা গেছে।
তবে হাসপাতালের এখনো জনবল থেকে শুরু করে নানা সঙ্কট রয়েছে চরম। এছাড়াও হাসপাতালের ট্রলিম্যানদের কাছেও জিম্মি হয়ে থাকেন রোগীর স্বজনরা। আবার হাসপাতালে দালাল ও আনসার সদস্যদের কখনো কখনো বাড়বাড়ি দেখে হতম্ভব হয়ে পড়েন রোগী ও স্বজনরা।
হাসপাতালের বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া রোগী সুশান্ত বলেন, ‘আমার পায়ে যে জটিল অপারেশন করা হয়ে, এই ধরনের অপারেশন এখন রাজশাহীতে হচ্ছে বলে আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়েছে। ঢাকায় বা ভারতে যেতে হলে আমার পক্ষে হয়তো এই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন রায় সম্ভব হত না।’
হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে জটিল কোলন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন নাটোরের গুরদাসপুরের আকবর আলী। সম্প্রতি প্রথম বারের মতো ঢাকার বাইরে এই ধরনের অপারেশনটি করানো হয়। ল্যাপারস্কোপির সার্জারির মাধ্যমে কোলন ক্যান্সার অপারেশনটি করেন হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক আরিফুল আলম সুমন।
তিনি জানান, এটি একটি জটিল অপারেশন। রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে এই প্রথম অপারেশনটি করা হয়। অপারেশন পরবর্তিও রোগী এখন ভালো আছেন। সাধারণত ঢাকায় বা বিদেশে এই ধরনের অপারেশন করা হয়। কিন্তু রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে এই প্রথম এই ধরনের অপারেশন করা হলো। তিনি আরো জানান, এই জটিল অপারেশনের জন্য ঢাকা থেকেও কিছু প্রয়োজনীয় মেশিন আনা হয়েছিল।
সার্জারি ওয়ার্ডের আরেক সহকারী অধ্যাপক আনম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ল্যাপারোস্কিপর মাধ্যমে রাজশাহী হাসপাতালে পেটের অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা এখন হচ্ছে। যেগুলো করতে বছর দুয়েক আগেও রোগীদের ছুটে যেতে হত ঢাকায় বা বিদেশে। এখন আমরাই সেইসব জটিল রোগের অপারেশন করে দিচ্ছে হাসপাতালে। ফলে রোগীদের যেমন ভোগান্তি কমে আসছে, তেমনি আর্থিক অপচয়টাও রোধ হচ্ছে। রোগীরাও হাতের কাছেই উন্নত চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন।’
এই হাসপাতালের কার্ডিওলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিশিথ কুমার মজুমদাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কিছুদিন আগেও একটু জটিল অবস্থা দেখলেই আমরা রোগীকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু এখন আমরা অনেক জটিল রোগীকেও চিকিৎসা দিচ্ছি রামেক হাসপাতালে। অনেক জটিল রোগী আমাদের ওপর আস্থা রেখে চিকিৎসা শেষে অনেকটা সুস্থ হয়েই বাড়ি ফিরছেন। এটা আমাদের কাছেও একটা বড় পাওয়া।’
এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মাণ বাড়লেও এখনো জনবলসহ নানা সঙ্কটের কারণে উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকসহ নার্সদের-এমনটিই দাবি করেছেন হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক।
তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক হাজার শয্যার হাসপাতাল কাগজে-কলমে হলেও এর জনবল এখনো বাড়েনি। রোগীর উপচে পড়া ভেিড়র মাঝে নানা সঙ্কটের কারণে উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে চিকিৎসকরা আন্তরিক থাকলেও-তা নানা সঙ্কটের কারণে হয়ে উঠছে না।’
অপরদিকে রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, ‘উত্তরাঞ্চলের গরিবদের ভরসা হয়ে আছে রামেক হাসপাতাল। হাসপাতালের ট্রলিম্যানদের কাছেও জিম্মি হয়ে থাকেন রোগীর স্বজনরা। রোগী আনা নেওয়া করতে ট্রলিম্যানরা ৫০ থেকে ১০০ টাকা আদায় করে থাকেন। এই টাকা পরিশোধই অনেক গরিব রোগীর ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এর বাইরে হাসপাতালের ভিতর দালালদের দাপটেও অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনরা। রোগীদের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে দালালরা অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে হরহামেশাই।
হাসপাতালের বার্ণ ও পালিস্টক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসা চুয়াডাঙ্গার রোগীর আক্তার হোসেন জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকেই তাকে বিভিন্ন পরীক্ষার নাম করে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় আল্ট্রা প্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এরপর এই পরীক্ষা সেই পরীক্ষার নামে তার নিকট থেকে এক হাজার ৯০০ টাকা আদায় করা হয়। আক্তার হোসেন বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। এমনতিইে ওষুধ কেনার টাকা পাচ্ছি না। আবার এভাবে প্রতারণা করে পরীক্ষার নামে এতোগুলো টাকা আদায় করেছে ওরা। এরা হাসপাতালে প্রবেশ করে কিভাবে?।’
ওই ওয়ার্ডের এক নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রামেক হাসপাতালে এখনো দালালদের দাপট চরম। তারা নানা ছদ্দবেশে এসে রোগীদের হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের পুলিশ বা আনসার সদস্যরা এসব দালালদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই রোগী ও রোগীর স্বজনরা প্রতারিত হচ্ছেন।’
এদিকে হাসপাতালে দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে কখনো কখনো বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায় রোগীর স্বজনদের সঙ্গে। হাসপাতালের প্রদান ফটকের সামনে বা ওয়ার্ডে আনসার সদস্যরা অতি উৎসাহী হয়েও ওঠেন কখনো কখনো। এদের মধ্যে রয়েছেন আনসার রফিক, ইদ্রিশ আলী, আনোয়ারসহ অন্তত ১০ জন।
তবে নানা সমস্যার পরে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মাণ অনেক বেড়েছে বলে দাবি করেন হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জামিলুর রহমান। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে টয়লেট পরিস্কার থেকে শুরু করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেবার মাণের দিক দিয়ে এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জরিপে দেশের প্রথম স্থানে রয়েছে। আমরা এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কাজ করে যাচ্ছি। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মাণ আরো বৃদ্ধির জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি দ্রুত রামেক হাসপাতালে আরো বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। silkcity

Next Post

স্যালুট দেয়া ভাইরাল ছবিটি নেপথ্যর ঘটনাটি জানিয়েছেন যশোরে সেই কৃতী ছাত্র নিজেই।

শুক্র অক্টো. ৫ , ২০১৮
আভা ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৫১তম সমাবর্তনে রিকসা চালককে গাউন পরিয়ে স্যালুট দেয়া ভাইরাল ছবিটি নেপথ্যর ঘটনাটি জানিয়েছেন যশোরে সেই কৃতী ছাত্র নিজেই। আসলেই ছবি বাবা-ছেলের কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়েছে প্রকৃত ঘটনাটা। ছবির ওই ছেলেটির নাম মোস্তাফিজুর রহমান লিটন ওরফে লিটন মোস্তাফিজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। কিন্তু রিকসা […]

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links