১৯৭১ সালের এই দিনে শক্রমুক্ত হয় রাজশাহী । আজ রাজশাহী হানাদার মুক্ত দিবস ।

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আজ ১৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে শক্রমুক্ত হয় রাজশাহী। ১৬ ডিসেম্বর দেশবাসী যখন বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা ছিলো, তখনো রাজশাহী শহরের রাস্তা ঘাটে টহলরত ছিলো শত্রু পক্ষের কনভয়। ১৭ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি আর্মি গোপনে নাটোর গিয়ে ১৮ ডিসেম্বর সকালে আত্মসমর্পণ করে। ওই দিনই রাজশাহীবাসী নেমে আসে রাজপথে। মাদ্রাসা মাঠে সংবর্ধনা দেন বীর যোদ্ধাদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১৬ ডিসেম্বর শক্রমুক্ত হয়। এরপর হানাদার বাহিনী এসে জড়ো হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে। মুক্তিবাহিনী ১৭ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় রাজশাহীতে প্রবেশ করে। তখন রাস্তায় নেমে আসে হাজারো উল্লসিত মানুষ। তখন পাকিস্তানি বাহিনী শহর ছেড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ শামসুজ্জোহা হলে গিয়ে সমবেত হয়। ১৭ ডিসেম্বর রাতে শক্রবাহিনী জোহা হল ছেড়ে গোপনে নাটোরে গিয়ে সেখানেই যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৮ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হাজার হাজার জনতা রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে সমবেত হন। তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিয়ে তাদের বরণ করে নেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, রাজশাহীকে শক্রমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকগুলো খণ্ড যুদ্ধ ও গেরিলা হামলা চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাতটি সম্মুখ যুদ্ধ ছিলো বেশ গুরুত্বপূূর্ণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের বিপরীতে অনুন্নত থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়েই অসম সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন মুক্তিকামী বাঙালিরা। রাজশাহীতে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিলো পুলিশ লাইনে। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ২৫ মার্চ ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রান্ত হবার পর প্রস্তুতি শুরু করে রাজশাহী পুলিশ লাইনের সদস্যরা। পাকিস্তানি সরকারের সব ধরনের অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ রাজশাহীর পুলিশ অমান্য করে। ২৬ মার্চ পুলিশ লাইন দখল নিতে পাকিস্তানি আর্মিরা রাজশাহী পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। পুলিশ সদস্যরাও বীরত্বের সঙ্গে পাল্টা জবাব দেন। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রাজশাহী পুলিশ লাইনের সদস্যদের লড়াই একটি গৌরবজ্জ্বল ঘটনা। পুলিশের সহযোগিতা না পাবার অজুহাত তুলে পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনে হামলা করার পরিকল্পনা করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী পুলিশ লাইন দখল করার জন্য পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলি বর্ষণ করে। এসময় পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। তারা রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণের এবং অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের আদেশ দেয়। তিনি অসম্মতি জানান। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ লাইনের কাছাকাছি এসে কয়েকটি গুলি ছোঁড়ে। জবাবে পুলিশ লাইন থেকেও গুলি ছোঁড়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা উপশহরের সেনানিবাসে ফিরে যায়। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে কয়েকজন নিরীহ লোক প্রাণ হারান। ২৬ মার্চ রাত প্রায় ১২টা ৫ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব দিকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে এগোতে থাকে। পুলিশ সদস্যদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ২৭ মার্চ সকাল থেকে আবারও পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। পুলিশ লাইনকে ঘিরে তারা আধুনিক ও ভারী অস্ত্র স্থাপন করে। যুদ্ধ প্রস্তুতির পাশাপাশি তারা কূটকৌশলেরও আশ্রয় নেয়। সকাল ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনীর এক কর্মকর্তা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মাইকের মাধ্যমে ‘ভাইয়ে ভাইয়ে’ আত্মঘাতি যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানান। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করতে বলেন।
কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ২৮ মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজর রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সাহায্য নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ করতে পুলিশ বাহিনীকে মাইকে আহ্বান করেন। দুই পক্ষ থেকে গুলি করা বন্ধ হলে মেজর তার পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় পূর্ব দিক থেকে পুলিশ লাইনে যান। ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবেন- এই আশ্বাস দিয়ে তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে সেনানিবাসের দিকে চলে যান। পুলিশ সদস্যরা মেজরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিরক্ষা সরিয়ে ব্যারাকে ফিরে আসেন। বাংকারে থেকে যান কয়েকজন পুলিশ সদস্য। দুপুর দুইটার দিকে পুলিশের সদস্যরা খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কেউ কেউ খেতে বসেছেন। এমন সময়ে পাকি বাহিনী মর্টার ও ভারি মেশিনগান নিয়ে তাঁদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশের সদস্যরা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। যাঁরা বাংকারে ছিলেন, তাঁরা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সন্ধ্যার আগেই পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। শেষ হয় রাজশাহীর প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। পুলিশ লাইনের ভয়াবহ যুদ্ধে শহিদ হন অন্তত ৬৯ জন পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে ১৭ জন শহিদ পুলিশ সদস্যের গণকবর রয়েছে পুলিশ লাইনের ভেতরে।
দিবসের কর্মসূচি
২০০৬ সাল থেকে দিনটিকে রাজশাহী প্রেসক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ রাজশাহী মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বিকেল ৩টায় সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট প্রেসক্লাব চত্বর এলাকায় স্মরণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
রাজশাহী প্রেসক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদের সভাপতি সাইদুর রহমানের সভাপতিত্ব এবং সাধারণ সম্পাদক আসলাম-উদ-দৌলার পরিচালনায় সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট কলামিস্ট মুক্তিযোদ্ধা প্রশান্ত কুমার সাহা।

পিএসএল

 

Next Post

১৮ ডিসেম্বর পাবনায় হানাদার মুক্ত হয় । আজ পাবনা হানাদার মুক্ত দিবস ।

বুধ ডিসে. ১৮ , ২০১৯
পাবনা প্রতিনিধি; আজ পাবনা হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ যখন বিজয়ের বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে মাতোয়ারা তখনও পাবনায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনার তুমুল যুদ্ধ চলে। ১৪ ডিসেম্বর দুপুর থেকে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল লড়াই শুরু হয়। এদিন দুপুর ২টায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী শহরে মটার শেল ও বিমান হামলা […]

এই রকম আরও খবর

Chief Editor

Johny Watshon

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit, sed do eiusmod tempor incididunt ut labore et dolore magna aliqua. Ut enim ad minim veniam, quis nostrud exercitation ullamco laboris nisi ut aliquip ex ea commodo consequat. Duis aute irure dolor in reprehenderit in voluptate velit esse cillum dolore eu fugiat nulla pariatur

Quick Links